ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের শিকার ইলিয়াস আলী! by ফজলুল বারী

ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ইলিয়াস আলীকে নিয়ে আমার লেখা বেশ কঠিন। অনেক বছরের সম্পর্ক। বাড়ি সিলেট হওয়াও এর অন্যতম কারণ। পেশা জীবনে সিলেটভিত্তিক জাতীয়-আঞ্চলিক অনেক তরুণ নেতার সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। সর্বশেষ ইলিয়াস আলী মাঝে মধ্যে ফেসবুকে ক্ষুদে বার্তা পাঠাতেন।

ঈদসহ নানা উপলক্ষে তার মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠালে তিনি ফোন করতেন। সর্বশেষ তার ফোন কলের সময় আমি ট্রেনের মধ্যে ছিলাম। ট্রেনের মধ্যে থাকা অবস্থায় ফোনেএলে অন্য যাত্রীদের বিরক্তি অথবা অসুবিধার কথা ভেবে আমি সাধারণত লম্বা কথা বলি না। ফোন কলটা রিসিভ করে বলে দেই পরে কথা বলবো।
লেখার স্বার্থে ব্যক্তিগত স্বার্থও ভুলে যেতে হয়। চোখ বন্ধ করতে হয়। সে কারণে সিলেটে খালেদা জিয়ার মহাসমাবেশের চাঁদাকে কেন্দ্র করে সৈয়দ মকবুল হোসেন ওরফে লেচু মিয়ার সঙ্গে তার যে বিরোধ হয়েছে, তা নিয়েও লিখেছি। সর্বশেষ তার নিখোঁজ হওয়ার খবরে ভয় তৈরি হয়েছে মনে। বাংলাদেশে এখন এমন একটি মধ্যযুগীয় অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, যারা নিখোঁজ হচ্ছেন, তারা আর ফেরত আসছেন না। আবার নিখোঁজ যারা হচ্ছেন, তাদের অনেকেই কিন্তু সফেদ চরিত্রের না। যখন ক্রসফায়ারের নামে লোকজনকে মারা হয়, তখন আমরা বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে প্রতিবাদ, হৈচৈ করি। এ জন্যেই বুঝি নতুন আরেকটি ভীতিকর পন্থা নেওয়া হয়েছে, নিখোঁজ-গুম! এসবের কোথাও কোনো সাক্ষী রাখা হচ্ছেনা।

এবার ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর খালেদা জিয়া এর জন্যে তার সৃষ্ট র ্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। বিএনপি নেতারাও বলেছেন, র ্যাব ইলিয়াস আলীকে তুলে নেওয়ার ব্যাপারে তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে।

রক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে রাজনীতি করা বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে রক্ষীবাহিনীর চেয়েও স্মার্ট একটি এলিট ফোর্স গঠন করে গেছে! নিজেদের সৃষ্ট হলে নিরীহ লিমনের পা কাটা গেলেও বিএনপি এর বিরুদ্ধে কথা বলে না। কোপটা নিজেদের পায়ে পড়লে বলে! খালেদা জিয়া আজকাল আবার সবকিছুতে আগামীতে দেখে নেওয়ার প্রতিহিংসার বক্তব্য দেন! তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদের সময় সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের আগামীতে ক্ষমতায় গেলে দেখে নেওয়ার কথা বলেছিলেন! ইলিয়াস আলীর ঘটনায়ও র ্যাব সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তারা যাতে মনে না করে এ সরকার চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে! খালেদা জিয়ার বক্তব্যের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, এই র ্যাব খালেদা জিয়া তৈরি করেছেন। তারা এখন তাদের মানবাধিকার শেখাচ্ছেন! দুই নেত্রীর কথার যোগফল হিসাব করে কী বলা যাবে ইলিয়াস আলী বিএনপির তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের শিকার! ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব যারা তৈরি করে তারাই এর ভিকটিম হয়। যদিও দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি সূত্র আমাকে বলেছে, র ্যাব এর সঙ্গে জড়িত নয়।

ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার পর তার স্ত্রী তাহসিনা রুশদি লুনা বলেছেন, ‘সে যেভাবে কথা বলতো, অনেককে ব্যক্তিগত আক্রমন করে বক্তব্য দিত, আমি নিষেধ করতাম। কিন্তু সে শুনতো না। সে তো রাজনীতি করে। কথা বলার জন্য কী এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে?’ সত্যি বলতে কী ইলিয়াস আলীসহ আরও কিছু ব্যক্তির বক্তব্যের ভাষায় মাঝে মধ্যে চমকে যেতাম বা এখনও যাই। দেশে গণতান্ত্রিক অবস্থা চালু আছে বলে মিডিয়া স্বাধীন, সবাই যার যার মতো কথা বলতে পারে। কিন্তু স্বাধীনতা মানে কী যা খুশি বলা? আমার কাছে বিষয়টিকে মাঝে মাঝে খুব উস্কানিমূলক মনে হয়। ভাবখানা এমন, পারলে কিছু কর! এসব ভাষা কিন্তু অনেক আক্রোশ তৈরি করতে পারে। প্রতিবাদী জ্বালাময়ী বক্তব্য রাজনৈতিক ভাষাতেও দেওয়া যায়। বিশেষ করে ইলিয়াস আলীর আজকের জনপ্রিয় রাজনৈতিক ভাবমূর্তি তৈরি হলেও তার অতীততো তার ভালো জানার, মনে থাকার কথা। আর কারও যদি অর্থনৈতিক জায়গাগুলো স্বচ্ছ না থাকে, তাদেরতো সবকিছু মাথায় রেখে চলা-কথা বলা উচিত!

ছাত্র রাজনীতিতে তার উত্থানটা রাজনৈতিক না। মস্তানির-সন্ত্রাসের। সে কারণে ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসার পর তাকে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক করা হলেও তিন মাসের মধ্যে তাকে অপসারণ করতে গিয়ে সে কমিটি পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর সন্ত্রাসের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পুরে প্রায় ২ বছর আটকে রাখেন খালেদা জিয়া স্বয়ং।

এরপর সাইফুর রহমান যতদিন সিলেট বিএনপির কর্তৃত্বে  ছিলেন, ইলিয়াস আলীকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেননি। যদিও তারেক রহমানের সরাসরি আর্শীবাদ ছিল ইলিয়াস আলীর প্রতি। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে সাইফুর রহমান একবার পদত্যাগ করতে গেলে খালেদা জিয়া হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি সামলান। তখন সাইফুর রহমানের ছত্রছায়ায় আরিফুল হক চৌধুরী গং’এর দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করলে ইলিয়াস আলীর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট হয়। ১/১১ ওয়ালাদের মদদে আলাদা বিএনপি গঠন ও পরবর্তীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে সাইফুর যুগের পতন ও ইলিয়াস যুগের জমকালো উত্থান হয়। সর্বশেষ সিলেটে খালেদা জিয়ার মহাসমাবেশের সাফল্যে পরিচয় মেলে তার সাংগঠনিক দক্ষতার।

খালেদা জিয়ার অন্যসব মহাসমাবেশে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের প্রাধান্য থাকলেও সিলেটে তা ঘটতে দেননি ইলিয়াস আলী। এ নিয়ে তার ওপর জামায়াত ক্ষিপ্ত হয়। খালেদা জিয়ার পাশে আসন দেওয়ার কথা দিয়ে টাকা নিয়ে কথামতো আসন না দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ লেচু মিয়া চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলেন ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে। বনানীর যে ছয়তলা বাড়ি সিলেট ভবনে এখন সবাই যাচ্ছেন, লেচু মিয়া তখন প্রশ্ন তুলে বলেন, যার স্বীকৃত কোনো ব্যবসা নেই, সে ঢাকার বনানীর মতো জায়গায় এত বড় বাড়ির মালিক কী করে হয়েছে। ইলিয়াস আলী অবশ্য লেচু মিয়ার কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

লেখালেখির কারণে নানা সূত্র থেকে নানাভাবে অনেক তথ্য পাই। এর মধ্যে গোয়েন্দা সূত্রের তথ্যও থাকে। বিদেশ থাকাতেও যেন অনেকে তথ্য দিতে নিরাপদ, স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যদিও রিপোর্টার হিসাবে জানি গোয়েন্দারা তথ্য দেয় নিজেদের স্বার্থে। অনেক সময় রিপোর্ট তারা খাওয়ানও! যেমন ১৯৯১-১৯৯৬- এর খালেদা জমানায় যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলছিল, তখন একরাতে গুরুত্বপূর্ণ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ফোন করে বলেন, সুধাসদনে এইমাত্র কে যেন গেছে। একটু খোঁজ নিয়ে আমাকে জানাবেন প্লিজ। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি বিএনপির একজন দূত শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আশায় সুধাসদনে গেছেন। তখন গোয়েন্দারা এসব রিপোর্ট মিডিয়ায় আসুক তা চাইতেন সরকারি স্বার্থে। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। ওই অবস্থায় বিরোধীদলের সঙ্গে সরকারের যে একটি যোগাযোগ সম্পর্ক আছে, তা মিডিয়ায় রেখে আন্দোলনে শান্তি রাখা অথবা বিভ্রান্তি সৃষ্টির অ্যাসাইনমেন্ট ছিল গোয়েন্দাদের। এবারের খবরটি অবশ্য সরকারি একটি সূত্রের। এই সূত্রও মাঝে মধ্যে নানা ইস্যুতে এডভান্স তথ্য দেয়। কোনোটা ফলে। কোনোটা ফলে না। যেমন ইলিয়াস আলী ইস্যুতে আমাকে তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, শনি অথবা রোববার তিনি উদ্ধার হতে পারেন।

কেন এটা ঘটলো জানতে চাইলে বলা হয়, ঘটনাটা রাজনৈতিক না, টাকাপয়সার লেনদেন সম্পর্কিত। কিছুদিন আগে উনি ডিওএইচএস এ ‘---’ কোটি টাকা দিয়ে আরেকটি বাড়ি কিনেছেন। সে বাড়ির পেমেন্ট নিয়ে ঘাপলা করলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা এর সঙ্গে জড়িয়ে যায়। সে রাতে রূপসী বাংলা হোটেলের বৈঠকটিও ছিল এ পেমেন্ট সংক্রান্ত। সূত্রটিকে নিজের সন্দেহ উল্লেখ করে বলি, এমন কাহিনী সরকারের হাতে থাকলেতো তা ঘটা করে মিডিয়াকে বলার কথা। জবাবে বলা হয়, যে সংস্থা কাজটি করেছে, তাদের মধ্যে দুটো গ্রুপ হয়ে গেছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘটনার পর এ ঘটনা ঘটিয়ে ওই পাড়ায় উস্কানি সৃষ্টির চেষ্টা আছে। এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আমাদের ওই মন্ত্রী। উনি একজন হোপলেস। জিজ্ঞেস করি এমন সংস্থা জড়িত থাকলে ওই মিনিস্টারের কী করার ছিল? এর উত্তরে বলা হয় এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে গোয়েন্দাদের সঙ্গে তার কর্ডিনেশন দুর্বল। তিনি হয়তো তাদের বার্তা পাচ্ছেন না অথবা তারা তাকে দিচ্ছে না। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহে দেশের বাইরে ছিলেন। আওয়ামী লীগও দল হিসাবে কোন একটিভ ভূমিকা রাখতে পারছে না। সাধারণ সম্পাদক আশরাফ সাহেবও হঠাৎ করে আরও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন’। সূত্রটির সঙ্গে আর কথা আগায়নি। সত্যি কী শনি-রোববার উদ্ধার হচ্ছেন ইলিয়াস আলী? এসব কথোপকথন লেখার কারণ, মন বলছে তাই যেন হয়। দেশে একটা মানুষ ভালো কী মন্দ তা দেখবে আইন, জনগণ। কোনো একটা মানুষ জ্বলজ্যান্ত নিখোঁজ-গুম হয়ে যাবে, এটা একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে কোনভাবে কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী এ ইস্যুতে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তা দেশের মানুষের মতো আমারও ভালো লাগেনি। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর ভাষা হতে পারে না।

লেখক: সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.