শিল্পিত অগ্রযাত্রার নতুন দুয়ার by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

বিশ্ব শিল্পকলার উত্তরণ কোনো ভৌগোলিক সীমায় আবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের শিল্পকলার সঙ্গে বৈশ্বিক শিল্পকলার সেতুবন্ধ তৈরি করেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, মোহাম্মদ কিবরিয়া, সফিউদ্দীন আহমেদ ও এস এম সুলতান।


শিল্পকর্মের বিষয়, মাধ্যম ও করণকৌশলের দিক থেকে পাশ্চাত্যের আভাস পাওয়া যায় পরবর্তী সময়ে দেশের বাইরে শিল্পকলায় উচ্চতর শিক্ষা শেষে ফিরে আসা শিল্পীদের কাজে। বিষয় নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষের জীবনাচরণের নানা অধ্যায় উঠে আসে মূর্ত, আধা বিমূর্ত ও বিশুদ্ধ বিমূর্ত শিল্পকর্মে।
১২ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ঢাকা আর্ট সামিট এযাবৎ বাংলাদেশে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বাইরে শিল্পী, শিল্পরসিক, দর্শক, ইতিহাসবিদ ও শিল্প-গবেষকদের বৃহৎ সম্মিলন। গত ছয় দশকের বাংলাদেশে সৃষ্ট শিল্পকর্মের গতিপথকে একসঙ্গে খুঁজে পাওয়া যায় এ সামিটে।
সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও জাতীয় জাদুঘরের যুক্ত হওয়া এ সামিট বিশ্বশিল্পরসিকদের আগ্রহী করে তোলে। এ বর্ণাঢ্য আয়োজন প্রসঙ্গে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক নাদিয়া সামদানীর মতো আমাদের শিল্পকর্মের সমৃদ্ধি বিশ্ববাসীর কাছে জানাতেই এ আয়োজন। বিভিন্ন দেশের ৩৮ জন শিল্পী, সমালোচক, গবেষক ও সংগ্রাহকের অংশগ্রহণ আমাদের দেশের শিল্পকর্মের প্রতি আগ্রহকেই বোঝায়।
২৪০ জন নবীন-প্রবীণ শিল্পীর বিভিন্ন মাধ্যমের কাজ দেখার এ বিরল সুযোগ মেলে ঢাকা আর্ট সামিটে। এ আয়োজন তিনটি পর্বে বিভক্ত ছিল বলা যায়: প্রথমত, ২৯ জন তরুণ শিল্পীর, যাঁদের বয়স অনূর্ধ্ব ৩৫, এদের বাছাইকৃত শিল্পকর্মের প্রতিযোগিতা; দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে সৃষ্ট বাংলাদেশের ২৭ জন পথিকৃৎ শিল্পীর ৭১টি কাজ নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন, তৃতীয়ত, ছয়টি সেশনে আধুনিক শিল্পকলা, এতে ছবির বিষয় ও ভাব বিনিময়, আলোকচিত্রের শিল্পগুণ, দক্ষিণ এশীয় শিল্পকলার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশীয় শিল্পকর্মের ভবিষ্যৎ, দক্ষিণ এশীয় শিল্পকর্ম সংগ্রাহক, শিল্পের বাজার প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই পর্বে বাড়তি আকর্ষণ ছিল শিল্পের বাজারে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বিষয়ে সেমিনার, বক্তব্য উপস্থাপন ও মতবিনিময়ের আয়োজন। এসব বিষয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশের শিল্পী, শিল্পসংগ্রাহক, ইতিহাসবিদ ও গবেষকেরা আলোচনা করেন। অন্যদিকে সামিটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে অপেক্ষাকৃত তরুণ শিল্পীদের প্রদর্শিত কাজ প্রথাগত ক্যানভাস ও রংতুলির সঙ্গে নতুন নিরীক্ষায় শিল্পকর্ম সৃষ্টি দর্শকদের ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
ঢাকা আর্ট সামিটের যাঁরা গেছেন, নিঃসন্দেহে বলা যায় এ আয়োজন আমাদের চিনিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের শিল্পকর্মের অতীত, বর্তমান ও আগামী।
শুধু তেল, জল, ছাপচিত্র, স্থাপনাশিল্প, ভিডিও আর্টের বাইরে আলোকচিত্রকেও সৌন্দর্যকলার অন্তর্গত করে দৃশ্যশিল্পের বৃহৎ একটি মাধ্যমের স্বীকৃতি এসেছে এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে।
ঢাকা আর্ট সামিটের এবারের সামদানী আর্টিস্ট ডেভেলপমেন্ট পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী হলেন খালিদ হাসান। ১০ লাখ টাকা মানের পুরস্কারপ্রাপ্ত তাঁর ছবির শিরোনাম ছিল ‘টেরর বিট অব এসিড ১, ২’। ছবি দুটিতে নারীমুখ ও এসিডে ঝলসানো দুই হাতে আঁকড়ে থাকা আরেকটি মানবীর মুখাবয়ব। ছবির তলে নীলাভ মৃদু আলোয় অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখ। সামাজিক বৈকল্য নারীর প্রতি সহিংস আচরণ নিয়ত আহত করে আমাদের। জুরি বোর্ডের সদস্যদের নির্বাচন সামাজিক অনাচারের বিপক্ষে প্রতিবাদ। পাঁচ লাখ টাকার সামদানী ইয়ং আর্ট ট্যালেন্ট পুরস্কার পেয়েছেন চট্টগ্রামের শিল্পী মুসরাত রিয়াজী। ‘মুরিং’ শিরোনামের তেলরঙে আঁকা ছবিতে রঙের উপস্থিতির চেয়ে রেখাই প্রধান বলা যায়। সাদা-কালো ঊর্ধ্বমুখী রেখায় তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ধেয়ে আসা তিনটি হিংস্র প্রাণীর অবয়ব ঘিরে রেখেছে তিনটি নারীদেহ। গত শতকের পরবর্তী সময়ে তরুণদের চিন্তায় সরলীকরণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছবির নান্দনিক বোধে বক্তব্যধর্মী উপস্থাপনা। কি চিত্রকর্মে, ভাস্কর্যে, ছাপচিত্রে, আলোকচিত্রে বিষয়কে নিয়ে নিরীক্ষায় মেতেছেন তরুণ শিল্পীরা।
১৫ এপ্রিল শেষ হওয়া ঢাকা আর্ট সামিটের তরুণ শিল্পীদের বর্ণাঢ্য প্রতিযোগিতায় জুরি হিসেবে এসেছেন ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী বোস কৃষ্ণামাচারি, প্যারিসের শিল্প-সমালোচক ও ইতিহাসবিদ দীপক আনান্থ, আর্ট এশিয়া প্যাসিফিক জার্নালের সম্পাদক ইলিন ডব্লিউ এনজি, ইন্টারন্যাশনাল আর্ট অ্যাট টেট মডার্নের সহকারী কিউরেটর কায়লা ম্যাকডোনাল্ড, ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী রাভিন্দার রেড্ডি।

No comments

Powered by Blogger.