সরেজমিন : খিলগাঁও থানা-'টাকা নেয়া ভুল হইছে ক্ষমা কইরা দিয়েন' by রাব্বী রহমান ও মাসুদ রানা

বুধবার রাত পৌনে ১টা। রাজধানীর তালতলা এলাকার খিলগাঁও থানা ভবন। ঢুকতেই ডিউটি অফিসারের কক্ষের দরজায় চোখে পড়ল দুটি স্টিকার। একটিতে লেখা 'র‌্যাব-পুলিশ আপনার বন্ধু, এদের সহায়তা করুন'। অপর স্টিকারে লেখা 'মাদক পরিহার করুন, নিজে বাঁচুন এবং আগামী প্রজন্মকে বাঁচান।'


তবে নিজ কক্ষে খোদ ডিউটি অফিসার এসআই শাহআলম ও ওয়্যারলেস অপারেটর নজরুল ধূমপান করছেন আয়েশি ভঙ্গিতে। অথচ সামনেই এক শিশু ও দুই নারীসহ ৮-১০ জন লোক বসা। তারা এসেছে মামলা করতে। ধূমপানের ফাঁকে এক ব্যক্তির সঙ্গে আড্ডায় মেতে ওঠেন ডিউটি অফিসার। ওই ব্যক্তিও ধূমপান করছিলেন এবং বসে ছিলেন চেয়ারে পা উঠিয়ে। ধূমপান করতে করতে ওয়্যারলেস অপারেটর নজরুল কাগজে লিখছেন এবং বৃদ্ধকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন। কথার ফাঁকে ওই বৃদ্ধকে দিয়ে একদফা সিগারেট ও চা আনান নজরুল। লেখা শেষে নজরুল কাগজটি দিলেন ডিউটি অফিসারের হাতে। ডিউটি অফিসার ধমকের সুরে বৃদ্ধকে বললেন, 'কি মিয়া, তাদের চা সিগারেট খাওয়াইলেন, আমারে খাওয়াইবেন না?' ডিউটি অফিসারের সামনের চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিও বলল, 'যা দৌড় দে, ভাইরে সিগারেট খাওয়া।' বৃদ্ধ লোকটি বাইরে বের হলেন এবং কিছুক্ষণ পর সিগারেট নিয়ে ফিরলেন। কিছুক্ষণ পর ডিউটি অফিসার শাহ আলমকে ৫০০ টাকা দিলেন ওই বৃদ্ধ। ডিউটি অফিসারের সামনে বসে থাকা লোকটি ওই বৃদ্ধকে বললেন, 'ওয়্যারলেস অপারেটর নজরুলকে ২০০ টাকা দাও।' বৃদ্ধ বাইরে এসে ৫০০ টাকার একটি নোট ভাঙিয়ে ওয়্যারলেস অপারেটরকেও ২০০ টাকা দিলেন।
ডিউটি অফিসারের কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর বৃদ্ধের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। জানা যায় তাঁর নাম রহিম মিয়া। বাসা খিলগাঁও রেললাইনের পাশেই। জমিজমার বিরোধের জের ধরে তাঁর মেয়ে আয়শাকে তাঁদের এক নিকটাত্মীয় মারধর করেছে। তাই থানায় মামলা করতে এসেছিলেন সবাই মিলে। কিন্তু পুলিশ বলছে, আগে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট আনতে হবে। অন্যথায় জিডি করতে হবে। আয়শা অসুস্থ বলে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন রহিম। রহিম মিয়া বলেন, 'দেখেন ভাই, এক ঘণ্টা ধরে কথা বলেও মামলা নিল না। জিডি করতে হলো।' কত টাকা দিলেন জানতে চাইলে হেসে বললেন, 'ভাই ৭০০ ট্যাকা।'
ডিউটি অফিসারের সামনের ব্যক্তিকে চেনেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তিনি হচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কাদের ভাই। হে প্রায়ই থানায় আসেন বিভিন্ন তদবির নিয়ে। দেখেন সে সামনে থাকতেও পুলিশরে ৭০০ টাকা দিতে হইল। দেশটা যে কই গেল।' এরপর চলে গেলেন রহিম মিয়া।
রাত ১টা। ডিউটি অফিসারের কক্ষের সামনে সার্ভিস ডেলিভারি অফিসারের কক্ষে শিশু ও দুই নারীসহ ৮-১০ জন তখনো অপেক্ষা করছে। সার্ভিস ডেলিভারি অফিসারের চেয়ারটি শূন্য। সামনে চেয়ারে বসে আছেন দুই নারী। দুজনের শরীরেই আঘাতের চিহ্ন। এক নারীর চোখে ব্যান্ডেজ। গায়ে রক্তের দাগ। কয়েকজন যুবক তাদের বিষয়ে ছোটাছুটি করছেন থানায় ও থানার বাইরে। মাঝেমধ্যে মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। ডিউটি অফিসারের রুমে এক যুবক ঢুকলে ওয়্যারলেস অপারেটর নজরুল বলেন, 'মেডিক্যাল সার্টিফিকেট না আনলে মামলা করা যাবে না।' ওই যুবককে বলেন, 'স্যার, গেছিলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সার্টিফিকেট দেয় নাই।' বসে থাকা নেতা কাদের বলে উঠলেন, 'দুই হাজার ট্যাকা দিলেই তো সার্টিফিকেট পাইতি।' এবার ওয়্যারলেস অপারেটর নজরুল বললেন, 'কাগজে একটা অভিযোগ লিখে দেন।' দুই যুবকের একজন নজরুলকে বললেন, 'স্যার, আপনে একটু লিখে দেন।' থানায় কোনো কাগজ নেই দাবি করে নজরুল বললেন বাইরে থেকে তাঁদেরই কাগজ আনতে হবে। যুবকরা বের হয়ে ছোটাছুটি করেন। কিন্তু এই গভীর রাতে কোথাও দোকানপাট খোলা নেই। ফিরে এসে বিষয়টি নজরুলকে জানানো হলে তিনি একটি কাগজ বের করে লিখতে শুরু করলেন। ওই সময় উিউটি অফিসার বসে থাকা স্থানীয় নেতা কাদেরকে বলছিলেন, 'যার বিরুদ্ধে অভিযোগ লিখাবে তারা আগেই জিডি করে গেছে। দেখ, তোমাগো মাইরা ওরা আগে জিডি দিছে। তুমরা এখন আইলা।' ভুক্তভোগীদের একজন বললেন, 'ভাই আমরা তো আগে মেডিক্যালে গেছিলাম। দেহেন না রুমার মারে মাইরা কী করছে। চোখ দিয়া রক্ত। আটটা সেলাই পড়ছে চোখে। তাই দেরি হইছে।'
কথা হলো তাঁদেরই একজনের সঙ্গে। নাম কামাল হোসেন। গোড়ানে বাসা। কামালেরই মেয়ে রুমা ও স্ত্রীকে পিটিয়েছে রুমার জামাই জুয়েল। ছয় বছর আগে জুয়েলের সঙ্গে বিয়ে হয় রুমার। একটি সন্তানও আছে। জুয়েলের বাসায় পাঁচ-ছয় দিন আগে একটি চুরি হলে কিছু গয়না খোয়া যায়। এই গয়না নাকি রুমা চুরি করে বাবার বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ জুয়েলের পরিবারের। এরপর রুমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি তারা, রুমাকে তাঁর বাবা কামালের বাসায় গিয়ে মারধরও করে। জুয়েল বর্তমানে বেকার ও মাদকাসক্ত অভিযোগ করে কামাল বলেন, 'নাতনির মুখের দিকে তাকাইয়া মেয়ে ওই পোলার ভাত খাইছে এতদিন। এখন আর মাইয়া দিমু না।' এরই মধ্যে কামালের সঙ্গে আসা এক যুবক এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এলেন ডিউটি অফিসার, ওয়্যারলেস ওপারেটর ও নেতা কাদেরের জন্য। সেখানে মাঝেমধ্যে কাদের ডিউটি অফিসারকে বলছেন, 'ভাই, আমার সেই মামলাটা দেইখেন।'
রুমার ভাই কামরুজ্জামানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, 'বসে থাকা ওই ব্যক্তি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা কাদের ভাই। এলাকায় বড় নেতা। হেরে অনেকে পাগলা কাদের বলে। কাদের ভাই তাদের চেনেন। কাদের ভাইরে ধইরা কিছু করন লাগব।'
ওয়্যারলেস অপারেটর নজরুলের লেখার কাজ শেষ। কাগজটি হাতে নিয়ে শাহআলম এক অফিসারের নাম বলতেই নেতা কাদের বললেন, 'না হেরে দিয়েন না। অন্য ভালো অফিসার দেন।' পরে কাদের যুবকদের বলল, 'তাদের কিছু খরচ দিয়া দে।' তখন এক যুবক ডিউটি অফিসারের হাতে কিছু ট্যাকা গুঁজে দিলেন এবং ২০০ টাকা দিলেন ওয়্যারলেস অপারেটর নজরুলকে।
ওই সময় সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এ প্রতিবেদক ডিউটি অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেন, 'জিডি বা মামলা করতে কি টাকা লাগে?' তখন সেখানে উপস্থিত সবাই ভড়কে যান। শাহআলম বলে ওঠেন, 'না ভাই, টাকা লাগে না।' 'তাহলে কিছুক্ষণ আগে একজনের কাছ থেকে এবং একটু আগে এই দুই ভুক্তভোগীর কাছ থেকে যে নিলেন?' প্রতিবেদকের এ প্রশ্নের জবাবে শাহআলম বলেন, 'না ভাই তারা খুশি হইয়া চা খাওয়ার জন্য দিছে। কষ্ট কইরা লিখা দিছে তাই খরচা-পাতি দিছে।' নেতা কাদেরকে তখন প্রশ্ন করা হয়, 'শুনলাম আপনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। আপনি কী করে তাদের কাছ থেকে টাকা চেয়ে ডিউটি অফিসারকে দিলেন?' কাদের বলেন, 'ভাই হেরা খুশি হইয়া ট্যাকা দিছে। দেহেন না ভাই মাইরা কি করছে। হ্যাগো লিগ্যা আমি আইছি।'
বিপদগ্রস্তদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পুলিশ থানায় বসে টাকা নিচ্ছে_বলা হলে শাহআলম উত্তর দেন 'ভাই আমি কখনো কারো কাছ থেকে চেয়ে টাকা নেই না। খুশি হয়ে কেউ দিলে সে ভিন্ন কথা। মানবিক দিক থেকে দেখলে এতে কোনো সমস্যা নেই।' এ পর্যায়ে নেতা কাদের এই প্রতিবেদকদের বলেন, 'শাহআলম ভাই খুব ভালো মানুষ। এই থানায় যে ওসি সে খুব শক্ত লোক। আগে মাদক ব্যবসা হইতো। এখন অনেক কম হয়।' ওই সময় এ প্রতিবেদকদের প্রশংসা করে বিদায় নেন কাদের। শাহআলম তাঁর চেয়ার থেকে উঠে আসেন প্রতিবেদকদের পিছু পিছু। থানার ফটকের বাইরে চায়ের দোকানের সামনে এসে বলেন, 'ভাই ১৫ হাজার টাকা বেতন পাই। ঢাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এ দিয়ে সংসার চলে না। খরচ আছে ৩০ হাজার, অথচ আয় মাত্র ১৫ হাজার। বাকিটা তো ম্যানেজ করতে হয়। সবাই এভাবেই ম্যানেজ করে। তবে আমি কখনো কারো কাছ থেকে চেয়ে বা আটকে টাকা নেইনি।' শাহআলম আরো বলেন, 'ভাই আমি খুব লজ্জা পাইছি। ওয়্যারলেস অপারেটর মুরুবি্ব নজরুলও লজ্জা পাইছে। ভাই এটা খুবই লজ্জার। আপনারা চাইলে আমার অনেক ক্ষতি করতে পারেন।' এ কথা বলেই হাত চেপে ধরেন এক প্রতিবেদকের। 'ভাই এ ভাইয়ের দিকে লক্ষ রাইখেন। ভাই ক্ষমা কইরা দিয়েন'_বলে থানায় ঢুকে যান শাহআলম। তবে কিছুক্ষণ পর আবার রাস্তায় আসেন তিনি। শাহআলম বলেন, 'ভাই যাবেন কী করে?' একই সঙ্গে এ বলে প্রতিবেদকের হাত চেপে ধরে কিছু টাকা দেওয়ার চেষ্টা করে বলেন, 'ভাই, সিএনজি ভাড়াটা নিয়ে যান।' বিপদগ্রস্তদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে শাহআলম বলেন, 'ভাই টাকা নেয়া ভুল হইছে, ক্ষমা কইরা দিয়েন...।'
এর আগে রাত সাড়ে ১১টার দিকের কথা। একজন ব্যক্তিকে নিয়ে থানায় ঢুকেছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা কাদের। ওই সময়ই থানা থেকে বের হচ্ছিল ৮ থেকে ১০ জন লোকের একটি দল। তাদের একজনের নাম রনি। মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। রনি বলেন, 'পারিবারিক সমস্যা। থানায় মামলা করতে এসেছি। তবে মামলা হয়নি, জিডি হয়েছে।' খরচ-পাতি কিছু দিতে হয়েছে কি না জানতে চাইলে রনি বলেন, 'থানায় পুলিশ বইসা থাকে খরচের লেইগা। খরচা তো কিছু হইছেই।' খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অভিযোগ নিয়ে আসা রুমাদের প্রতিপক্ষ তারা। দুই পক্ষের মারামারিতেই রনি জখম হয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.