রাষ্ট্রক্ষমতা ও ছাত্র রাজনীতির গতিপ্রকৃতি by ড. মাহবুব উল্লাহ্

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র আবুবকর ছিদ্দিক চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। তার মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। একটি ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে গত ১ ফেব্রুয়ারি রাতে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে তাতে আহত হয় ৫০ জনের মতো এবং আবুবকর ছিদ্দিক মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে প্রায় তিনদিন চৈতন্যহীন থাকার পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

তার এভাবে অসময়ে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার ঘটনা দারুণভাবে মর্মাহত করেছে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকে। আরও মর্মান্তিক ব্যাপার হলো ভাষার মাস, শোকের মাস এই ফেব্রুয়ারিতেই ঘটল আরেকটি শোকের ঘটনা। টাঙ্গাইলের একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান আবুবকর ছিদ্দিকের মৃত্যু তার পরিবার ও স্বজনদের জন্য এমনি হৃদয়বিদারক ঘটনা যে কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে তার অভাব পূরণ করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, তার পরিবারকে যথোচিত সহায়তা দেয়া হবে; কিন্তু যত সহায়তাই দেয়া হোক না কেন তা কি কোনোভাবেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণের মূল্য পরিশোধ করতে পারবে? এ দেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু একটি নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্রের পাতায় যখন এসব অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়, তখন পাঠকের মনে নাড়া পড়ে; কিন্তু সেই অনুভূতি হারিয়ে যেতে সময় লাগে না। নিয়তির অমোঘ নিয়মের মতো এসব বেদনাদায়ক ঘটনাকে ভুলে যেতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। জীবনের স্বাভাবিক ধারাকে ভঙ্গ করে যেসব ঘটনা কালেভদ্রে ঘটে সেগুলো আমাদের স্মৃতিপটে যেভাবে আসন পাতে নিত্যদিন ঘটে যাওয়া ট্র্যাজিক ঘটনাগুলো আমাদের আর তত গভীরভাবে স্পর্শ করে না।
মধ্যযুগের ইউরোপে শিশু-মৃত্যুর ঘটনা বেশুমার ঘটত। তখনকার ইউরোপে সন্তান বিয়োগের ঘটনাকে ইউরোপীয়রা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম হিসেবেই ধরে নিত। বাংলাদেশেও একটি বহুল পরিচিত বচন হলো ‘মরা ছেলে নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই।’ এই বচনটিরও উদ্ভব সম্ভবত ইউরোপের মধ্যযুগে বিদ্যমান অবস্থার সঙ্গে তুলনীয়। অর্থাত্ পিতামাতা অনেক সন্তান-সন্তুতির জনক-জননী হন বটে; কিন্তু তাদের বেশিরভাগই রোগব্যাধিতে অকাল মৃত্যুবরণ করে বলে এমনি একটি বচনের উদ্ভব ঘটেছে। চিকিত্সাবিদ্যায় অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে এখন আমাদের মতো দেশেও শিশুমৃত্যুর হার এবং সামগ্রিকভাবে মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে; কিন্তু সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়ায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ থেকে কি কোনো পরিত্রাণ নেই? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হলে একটি ছাত্র সংগঠনের দুটি গ্রুপের মধ্যে সিট দখলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষটি ঘটেছিল। গত কয়েক মাস ধরে সংবাদপত্রে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণহীন কর্মীরাই এজন্য দায়ী।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতা আছে তারাই বেশি করে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজে জড়িত। প্রশ্ন হলো কেন তারা এসব বিশৃঙ্খলা ঘটাচ্ছে; কেনইবা তারা ভাতৃ হননের কাজে লিপ্ত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ছাত্র ভর্তি হয় তাদের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন সুবিধা নেই। ফলে মফস্বল থেকে আগত ছাত্ররা ফ্লোরিং ডাবলিং করে কোনো রকমে রাত যাপনের একটা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে। অনেকের কপালে তাও জোটে না। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে হলের সিট হয়ে দাঁড়ায় মহামূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদ যে বা যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারা এই পাবলিক প্রপার্টিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করে বিরাটভাবে লাভবান হতে পারে। তবে পাবলিক প্রপার্টিকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হয়। দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তাতে একমাত্র শাসকদল ঘনিষ্ঠরাই এই সুবিধা নিতে পারে; কিন্তু যখন দেখা যায় শাসকদল ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি অংশ এভাবে লাভবান হচ্ছে, তখন তাদের মধ্যেরই বঞ্চিত একটি অংশ এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং উল্লিখিত পাবলিক প্রপার্টির উপর ভাগ বসাতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ভাগাভাগির ব্যাপারে তারা যদি কোনোরূপ শান্তিপূর্ণ ফয়সালায় পৌঁছাতে পারে তাহলে হয়তো সংঘর্ষ হয় না; কিন্তু তার পরেও সমস্যা থেকে যায়। কারণ, এ ধরনের সমস্যায় কেবল শাসকদল আশ্রয়ীরাই কিছু সুবিধাভোগ করে, অন্যরা নয়।
আমাদের দেশে জাতীয় সংসদের একেকটি নির্বাচনের পর বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও হাটবাজারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলদারিত্বে পরিবর্তন ঘটে। কারণ সেই একটাই, ক্ষমতার পালাবদল। ২০০১ সালের নির্বাচনে যখন চারদলীয় জোট বিপুলভাবে জয়লাভ করে, তখন রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলাফল কী হবে তা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। মজার ব্যাপার হলো তখনকার সংবাদপত্রে জেনেছি ভোর হওয়ার আগেই পূর্বেকার ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছাত্রনেতা ও কর্মীরা নীরবে আবাসিক হলগুলো ছেড়ে দেয়। এভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর উপর কর্তৃত্বের মিউজিক্যাল চেয়ার আবর্তিত হচ্ছে পঞ্চবার্ষিকভাবে; কিন্তু অর্থনৈতিক দক্ষতা ও কাম্যতার বিচারে এ ধরনের ঘটনা কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না। কারণ, এতে করে ন্যায্যতা লঙ্ঘিত হয়, সুযোগ-সুবিধা অপাত্রে যায়। যোগ্যরা বঞ্চিত হওয়ার ফলে সমাজকে তারা যা দিতে পারত সমাজ তা থেকে বঞ্চিত হয়।
শিকাগো স্কুলের অনুসারী অর্থনীতিবিদরা বলবেন, আবাসিক হলে সিট ভাড়া চাহিদা ও যোগানের নিরিখে যে ভাড়া হওয়া উচিত তার চেয়ে কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ভাড়া অনেক কম হওয়ার ফলে সিটপ্রার্থী সংখ্যা ভয়ানকভাবেই বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী জোরজবরদস্তি করে এর উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে নিজেরা লাভবান হয় কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বঞ্চিত হয় বিপুল সম্ভাব্য আয় থেকে। অন্যদিকে সামাজিক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদরা বলবেন ভাড়া বাড়িয়ে দিলে গরিব কিন্তু মেধাবীরা বঞ্চিত হবে। ফলে বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে, যা মোটেও কাম্য নয়। সুতরাং কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো সুশাসন দৃঢ়তার সঙ্গে নিশ্চিত করে কম খরচে শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে অর্থনৈতিক বাজারের সঙ্গে রাজনৈতিক বাজারের একটি পার্থক্য আছে। রাজনৈতিক বাজারে রাজনীতিবিদদের লক্ষ্য থাকে তাদের ভোটের সংখ্যা সর্বাধিকরণ। ফলে তারা ভোটের সংখ্যা কমে যেতে পারে ভেবে সুশাসনের পথ গ্রহণ না করে অধিকতর সুবিধাজনক ভোট সংগ্রহকারী যোগাড়ে ব্যস্ত থাকে। এর বলি হয় সুশাসন।
বিভিন্ন কলেজে এখন সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি চলছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রী ভর্তি করার কথা। সেখানেও বাদ সেধেছে শাসকদলের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ছাত্র সংগঠনের কিছু বিপথগামী নেতা-কর্মীদের ভর্তিবাণিজ্য। তারা কলেজ কর্তৃপক্ষের উপর তাদের নির্ধারিত কোটা অনুযায়ী ভর্তির জন্য চাপ দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ঢাকা কলেজের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকবৃন্দ দারুণ অসহায় অবস্থায় পড়েছেন। রাজনৈতিক পরিবেশ বৈরী হলে জাতির বিবেক শিক্ষকরাও যে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেন, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের অবস্থা দেখে তাই মনে হচ্ছে। ইডেন কলেজেও ভর্তিবাণিজ্য চলছে বলে অভিভাবক ও ছাত্রীরা টিভি চ্যানেলের পর্দায় উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করেছে; কিন্তু কলেজ অধ্যক্ষ মানতে রাজি নন কোনো অনিয়মের কথা। তিনি হয়তো বিদ্যমান ক্ষমতার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলেই ভাবছেন। সমাজে সুবিধাবাদীদের সংখ্যা বেড়ে গেলে নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষে নৈতিকতাকে আঁকড়ে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। দেশে যে নৈতিকতাবোধসম্পন্ন মানুষ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছাত্র রাজনীতির নামে আজ যে অনৈতিকতা ও নৈরাজ্য চলছে তাকে আর যাই বলা যাক, ছাত্র রাজনীতি বলা যায় না। এ দেশে অতীতে ছাত্রসমাজ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। দেশের বহু অর্জনের সঙ্গে ছাত্র সমাজের নাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আজ সে গৌরব লুপ্তপ্রায়। শাসকদল বিরোধী বড় ছাত্র সংগঠনটির হাল অবস্থাও মোটেও সন্তোষজনক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র কিছুদিন আগে এই ছাত্র সংগঠনটিও আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এতক্ষণ যে বিশ্লেষণ হাজির করা হয়েছে তার নিরিখে তাদের মধ্যে অন্তর্কলহ হওয়ার কথা নয়; কিন্তু হয়েছে। এই মুহূর্তে তারা রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হলেও অতীতে সংশ্লিষ্ট ছিল এবং ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। সে কারণে যারা পদপদবি পাবে তারা ভবিষ্যতে সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ব্যাপারে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। এ জন্যই পদপদবি পাওয়া এবং না পাওয়াদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ।
তাদের সংঘাতের সুযোগে ক্ষমতাসীন পক্ষের সমর্থকরাও এই সংঘর্ষের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যদি বিরোধীপক্ষের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করা যায় তাহলে লাভবান হবে ক্ষমতাসীন পক্ষ। রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাই বাংলাদেশের প্রধান প্রধান ছাত্র সংগঠনগুলোকে আদর্শবাদ হারিয়ে বিত্তবৈভব অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত করেছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামগ্রিকভাবে জাতীয় অগ্রগতি। একদিকে রাষ্ট্রীয় সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং অন্যদিকে নৈতিকতা ও আদর্শবাদিতা নিশ্চিত করতে পারলে ছাত্র রাজনীতি অন্ধকারের করাল গ্রাস থেকে মুক্তি পাবে। দিনবদল যাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল, মূলত ও প্রধানত তাদের কাছ থেকেই জাতি এরূপ পদক্ষেপ কামনা করে।
লেখক : অধ্যাপক, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.