চারুশিল্প-ছাপাই ছবির বঙ্গানুবাদ by সিলভিয়া নাজনীন

চিত্রশিল্পের হাজার বছরের ইতিহাসে ছাপচিত্র অপেক্ষাকৃত নতুন মাধ্যম। ক্যানভাস পেইন্টিংয়ের কিছু সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে অনেকটা সময়ের প্রয়োজনেই ছাপাই ছবির উৎপত্তি। প্রথম ছাপচিত্র কোনটি, তার কোনো গ্রহণযোগ্য নমুনা পাওয়া যায়নি। তবে গুহামানবদের হাতের ছাপকে বলা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনায় ছাপচিত্রের ভাবনার সূচনাপর্ব।


কালক্রমে ছাপাই ছবির আধিক্য ব্যাপক আকার ধারণ করে; মূলত শিল্পের সহজ বিস্তৃতির উদ্দেশ্যে। সে সময় পঞ্জিকা, ধর্মগ্রন্থ, গল্প-কাহিনির বইয়ে ইলাস্ট্রেশনের জন্য ছাপচিত্র মাধ্যম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ছাপচিত্রে একটি শিল্পকর্মের অসংখ্য সংস্করণ সহজেই সম্ভব বলে স্বল্পমূল্যে শিল্পানুরাগীদের কাছে পৌঁছতে পারে। শিল্পের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ তৈরির একটি প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা যেতে পারে ছাপচিত্রের মাধ্যমকে।
বাংলার প্রথিতযশা ছাপচিত্রীদের নিয়ে ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রকে আয়োজন ছিল ছাপচিত্রের প্রদর্শনী। দুই বাংলার স্বনামধন্য ছাপচিত্রীদের শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছিল এ প্রদর্শনীতে। ভারতের বিনোদবিহারী মুখার্জি, রামকিঙ্কর বেইজ থেকে শুরু করে সলিল সাহানীর মতো খ্যাতিমান শিল্পীদের শিল্পকর্ম ছিল প্রদর্শনীতে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানের পাশাপাশি বর্তমান সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীদের শিল্পকর্মও উপস্থাপিত হয়েছে।
পর্তুগিজদের মাধ্যমে উপমহাদেশে মুদ্রণশিল্পের আবির্ভাব; তবে এর বাইরে নান্দনিক শিল্পসৃষ্টি প্রচেষ্টায় ইংরেজদের ভূমিকাই প্রধান। অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা মূল কেন্দ্র ছিল শিল্প-সাহিত্যচর্চার। ইংরেজদের ভারত শাসনের কেন্দ্র এই কলকাতাতেই গড়ে উঠেছিল মুদ্রণশিল্পের কারখানা। আর কলকাতার বাইরে ঢাকাও প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
উডব্লক-উড এনগ্রেভিং-মেটাল এনগ্রেভিং ছাপচিত্রের প্রাচীনতম ধারা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে লিথোগ্রাফের সূচনা। বাংলাদেশের ছাপচিত্র চর্চা পাশ্চাত্য ধাঁচকে অনুসরণ করে চলেছে দীর্ঘকাল থেকেই। বাংলাদেশে ১৯৪৮ সালে শিল্পচর্চার প্রথম পদক্ষেপ ছিল চারু ও কারুশিল্প। আর এ জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তখন থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক শিল্পসৃজনের নতুন স্রোত তৈরি হয়। এ দেশের ছাপচিত্রের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা হয় শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে। চারুচর্চায় উড-কাট এবং উড এনগ্রেভিং দিয়ে শুরু করলেও কালক্রমে এখানে অ্যাচিং, অ্যাকুয়াটেন্ট, লিনোকাট, ড্রাইপয়েন্ট, লিথোগ্রাফের চর্চাও বিস্তৃতি লাভ করে।
উপমহাদেশে আধুনিক ছাপচিত্রের ধারাকে টেকনিক আর বিষয়বস্তুতে বিভিন্ন নিরীক্ষায় সমৃদ্ধ করে চলেছেন এই মাধ্যমের অসংখ্য শিল্পী। এ প্রদর্শনীতে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের ছাপচিত্র দেখার সুযোগ তৈরি হয়েছে। রেখাধর্মী, বর্ণময় বিমূর্ততার সঙ্গে দক্ষতা ছাপাই ছবিতে নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান প্রমুখের ছাপচিত্র এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত স্থান পেয়েছে। উল্লেখ করা যায়, তাঁদের চিত্রের বিষয়বস্তুতে তাঁদের নিজস্বতার প্রতিফলন রয়েছে, সে সময় ছাপচিত্রে যে প্রাতিষ্ঠানিক রীতি চলছিল, তাঁরা এর বাইরেই ছিলেন। জয়নুল আবেদিনের শক্তিশালী রেখামাধ্যমের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য উচ্চকিত। এ ছাড়া শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আবদুল বাসেত, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ পথিকৃৎ শিল্পীর শিল্পকর্ম একই সঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে।
ভারতের শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজের সাবলীল রেখার বিচরণ, কে জি সুব্রামানিয়ামের স্টাইলাইজেশন, সানাৎ করের কোমল, সূক্ষ্ম রেখা, সোমনাথ হোরের বলিষ্ঠ উপস্থাপন আর বিষয়বস্তুর গভীরতা, যোগেন চৌধুরীর নিজস্বতা, করণকৌশল আর নিরীক্ষার ভিন্নতা এ সময়ের ছাপচিত্রীদের জন্য নতুন ভাবনা-দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর তৈরি করবে।
গ্যালারি চিত্রকের এ ধরনের একটি আয়োজন প্রশংসার দাবিদার। প্রদর্শনীতে ছাপচিত্রের ধারাবাহিকতা, সুস্পষ্ট বিবর্তন এবং বর্তমান গতি-প্রকৃতির একটি প্রচ্ছন্ন অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। শিল্পপ্রেমীদের দুই বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীদের শিল্পকর্ম দেখার দুর্লভ সুযোগ হয় চিত্রকের এই চমৎকার আয়োজনে। যা ছাপচিত্র চর্চায় গতি সঞ্চার করবে।
প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য শিল্পীরা হলেন: বিনোদবিহারী মুখার্জি, রামকিঙ্কর বেইজ, হরেণ দাস, সোমনাথ হোর, কে জি সুব্রামানিয়াম, লালু প্রসাদ, যোগেন চৌধুরী, পিনাকী বড়ুয়া, তপন ভৌমিক, কবিতা নায়ার, সলিল সাহানী প্রমুখ (ভারত); শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, আবুল বারক আলভী, রোকেয়া সুলতানা, আহমেদ নাজীর, রশীদ আমিন প্রমুখ (বাংলাদেশ)। ১০ এপ্রিল শুরু হওয়া প্রদর্শনী ২০ এপ্রিল শেষ হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.