সমকালীন প্রসঙ্গ-মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু-সুহৃদদের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা এবং মুক্তিকামী মানুষের লড়াই by ইমতিয়াজ আহমেদ

দুঃসময়ের সুহৃদ ও বন্ধুদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এমন আয়োজন সচরাচর দেখা যায় না। তাদের সবাইকে অভিবাদন। আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে আবেদন, তাদের কাছ থেকে সবাই যেন যথাযথ প্রেরণা লাভ করে। বিশ্বের কোথাও যদি মানবতা লাঞ্ছিত হয়, গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাতের চেষ্টা হয়,


স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যদি হুমকির সৃষ্টি হয় তা যেন দ্রুতই আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে তোলে

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামে বিশেষ অবদান রেখেছেন যেসব বন্ধু ও সুহৃদ, তাদের বিশেষ সম্মাননা দিচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। সম্মাননা যাদের দেওয়া হবে তাদের তালিকা আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি। এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার নানা দেশের অনেক নারী-পুরুষের নাম রয়েছে এখানে। শুধু দেশের ক্ষেত্রেই বৈচিত্র্য নেই_ ভাষা, সংস্কৃতি, পেশা ও মতাদর্শেও রয়েছে ভিন্নতা। তাদের কেউ ভারতের, কেউ যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার, কেউ ব্রিটেন কিংবা ইতালির। কেউ সুইডেনের, কেউবা জাপান অথবা কিউবার। জার্মানি-অস্ট্রিয়া-আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স-আয়ারল্যান্ড-যুগোস্লাভিয়া-ভিয়েতনামেও ছিল একাত্তরের গৌরবের সংগ্রামে বাংলাদেশের পক্ষ নেওয়া অনেক মানুষ। কেন তারা বাংলাদেশের পাশে পরম বন্ধুর মতো সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, এ প্রশ্ন নতুন প্রজন্ম করতেই পারে। এর উত্তরে যাওয়ার পাশাপাশি আমিও একটি প্রশ্ন রাখব_ এ সম্মাননার আয়োজন থেকে তারা কী শিক্ষা নিতে পারেন।
সম্মাননা জানানো হবে ফিল্ড মার্শাল এসএএম মানেকশ, লে. জেনালের জগজিৎ সিং অরোরা এবং লে. জেনারেল জ্যাকবের মতো কৃতী সেনানায়কদের। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল সামরিক অভিযান। ভারতের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলে যৌথ কমান্ড গঠন করেছিল এবং দুই দেশের মিত্রবাহিনীর কাছেই ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তাদের পাশাপাশি আমরা দেখি পণ্ডিত রবিশঙ্কর, লতা মুঙ্গেশকর, জর্জ হ্যারিসন, ভূপেন হাজারিকা, জোয়ান বাইজের মতো সঙ্গীত ও সুরের ভুবনের দিকপালদের। তালিকায় আরও দেখি সাংবাদিক সায়মন ড্রিং, সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, চিকিৎসক রথীন দত্ত, চিত্রনির্মাতা লিয়ার লেভিন, ফরাসি দার্শনিক ও লেখক আঁদ্রে মালরো, কবি অ্যালেন্স গিন্সবার্গ, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি, জাপানের অধ্যাপক ইওশি নারার নাম। ভূপেন হাজারিকার অবিনাশী গান 'মানুষ মানুষের জন্য'_ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকে তারা নিজেদের যুদ্ধ মনে করেছিলেন। সব ঋণ শোধ করা যায় না। বাংলাদেশের জনগণ কৃতজ্ঞচিত্তেই এ ঋণের কথা স্মরণ করে যাবে এবং খানিকটা বিলম্বে হলেও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা তারই অংশ।
একাত্তরের বিশ্ব প্রেক্ষাপট আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। কীভাবে অল্প সময়ের ব্যবধানে তাদের কাছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃৃশংসতার খবর পেঁৗছেছিল? সে সময়ে মোবাইল ফোন ছিল না। টিঅ্যান্ডটি ফোনের আওতাও ছিল সীমিত। বাংলাদেশ যে ভূখণ্ড নিয়ে গঠিত, তার বিচ্ছিন্নতা ছিল আরও বেশি। তারপরও বিশ্বের সর্বত্র বাংলাদেশের বন্ধু ও সুহৃদের দল কীভাবে সক্রিয় হতে পারল? তাদের স্বার্থই-বা কী ছিল? শামসুর রাহমানের কবিতার মতো প্রশ্ন করা যায় : 'আমরা এখানে কেন এসেছি/এখানে কী কাজ আমাদের'।
তাদের এভাবে ছুটে আসার পেছনে তিনটি মূল কারণ আমরা উল্লেখ করতে পারি।
এক. বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছিল। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ গোটা পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তাদের এককভাবেই সরকার গঠনের মতো অবস্থা ছিল। সাধারণ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর সেনাশাসক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই নির্বাচনে পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য সুযোগ এনে দিয়েছিল, যা ১৯৪৭ সালে দেশটি প্রতিষ্ঠার পর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ছিল অনুপস্থিত। যেসব দেশের সরকার ও বিশিষ্ট নাগরিকরা বাংলাদেশের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিলেন, সেখানে গণতন্ত্র চালু রয়েছে। শেখ মুজিব গণতন্ত্রের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত, এ বার্তা তাদের কাছে ছিল। তিনি শুধু নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেননি, আচরণেও ছিলেন গণতান্ত্রিক। ইয়াহিয়া খান একতরফাভাবে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকেন। এ সময়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বেসামরিক প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে তার নির্দেশে চলছিল, কিন্তু তা শান্তি বিঘ্নের কারণ হতে পারেনি। নির্বাচনে জনগণ তাকে ও তার দল আওয়ামী লীগকে যে ম্যান্ডেট দিয়েছিল তার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের দাবি তিনি করেছিলেন এবং সেটা ছিল ন্যায্য। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদানের সময়ও তিনি সচেতন ছিলেন যাতে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে প্রমাণ করা না যায়। এসব কারণে গণতন্ত্রকামী বিশ্ব বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা করেনি। বরং তাদের মনে হয়েছে_ বাঙালিদের লড়াই ন্যায়ের এবং এর পাশে দাঁড়ানো নৈতিক দায়িত্ব। শুধু রাজনীতিবিদদের জ্বালাময়ী ভাষণ নয়, রবিশঙ্করের সুর, জর্জ হ্যারিসন-জোয়ান বেইজের কণ্ঠ, সায়মন ড্রিংয়ের লেখনী এবং দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের দরাজকণ্ঠ বাংলাদেশের পক্ষে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে দাঁড় করিয়েছেন কাঠগড়ায়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম-নিষ্ঠুর গণহত্যা বিশ্ব বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। সায়মন ড্রিংয়ের মতো সাংবাদিকরা ২৫ মার্চের পরপরই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়নের ফলে 'লাশের স্তূপের নিচে যে পাকিস্তান নামের দেশটি চাপা পড়েছে', সে খবর বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী যখন বলেন, যে ক্যাম্পাস আমার ছাত্রছাত্রীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে সেখানে আমি ফিরে যেতে পারি না, তখন তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার অনেক অনেক মানুষ আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পাশে এসে দাঁড়িয়ে যায়।
মাত্র তিন দশকেরও কম সময়ে বিশ্ব জার্মান ফ্যাসিবাদের তাণ্ডব দেখেছে। এশিয়ায় জাপানিরাও চালিয়েছে গণহত্যা। আবার এই দেশটির হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা হামলায় মুহূর্তে ঝরে গেছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। ভিয়েতনামে ষাটের দশকে সৃষ্টি হয়েছে মাইলাই হত্যাকাণ্ড। নাইজেরিয়ার বায়াফ্রায় পরিচালিত হয়েছে গণহত্যা। বিশ্ববাসী কোনো অবস্থাতেই আরেকটি গণহত্যা মেনে নিতে রাজি ছিল না। বিশেষ করে এমন একটি ভূখণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষকে পাইকারিভাবে হত্যা করতে শুরু করে, যাদের পক্ষেই ছিল সত্য ও ন্যায়। বিবেকবান সব মানুষের পাশে না দাঁড়ানোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে থাকে। তারা এ খবর পায় সাংবাদিকদের সূত্রে কিংবা কনসার্টে শিল্পীর গানের কথায় সরকারি গোপন নথিতে। একবার ভাবুন সেই সময়ে আমাদের বন্ধুুদের দারুণ তৎপরতার কথা_ রিচার্ড টেলর শুনলেন যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্রের জাহাজ চলে যাবে পাকিস্তানে, যা ব্যবহার করা হবে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য। তিনি এটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। শুরু করলেন এর বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান এবং একই সঙ্গে আরও কিছু মানুষকে একত্র করে টানা পাঁচদিন ঘিরে রাখেন বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দর। ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ প্রতিবেদন প্রেরণ করেন যে এখানে গণহত্যা শুরু হয়েছে। অতি গোপনীয় এ প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেন সাহসী সাংবাদিকরা এবং তা আলোড়ন সৃষ্টি করে সর্বত্র।
তৃতীয় যে কারণের কথা বলব সেটা হচ্ছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলাদেশের শরণার্থীর স্রোত। এ সংখ্যা অল্প সময়ের মধ্যে এক কোটিতে পেঁৗছে যায়। ত্রিপুরা রাজ্যের লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি শরণার্থী সে সময়ে হাজির হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে। শরণার্থীদের দুর্দশার খবর বিশ্বের সর্বত্র দ্রুত পেঁৗছে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ সমস্যা প্রকট হয়ে পড়েছিল। এ কারণে জাতিসংঘ গঠনের পর ইউএনএইচসিআর নামের একটি সংস্থাও গঠিত হয়েছিল। ষাটের দশকে স্নায়যুদ্ধের কারণে পূর্ব ইউরোপেও শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। গণহত্যা থেকে বাঁচার জন্যই লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, এটা বিশ্ববাসীর বুঝতে সমস্যা হয়নি। তারা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি যখন জলকাদার পরিবেশে থাকা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন, টিভি পর্দা ও সংবাদপত্রে সে ছবি দেখে বিশ্ববিবেক জেগে উঠেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোগব্যাধিতে অনেকের মৃত্যু হয়েছে। অনেক নারী গর্ভের সন্তান হারিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা যখন হিসাব করি, তখন কিন্তু তাদের কথাও আমাদের স্মরণে রাখা দরকার।
লন্ডন থেকে এফআরসিএস করা রথীন দত্ত বলেন যে, ত্রিপুরায় তার সঙ্গে যেসব চিকিৎসক শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন তাদের অনেকে নির্ধারিত সময়ে সরকারি চাকরি করার পর অতিরিক্ত সময়ে বাংলাদেশের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন।
যে কোনো মুক্তির সংগ্রামে মূল বিষয় থাকে মানুষ। একাত্তরে যেমন গোটা বাংলাদেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল এক মহৎ লক্ষ্য অর্জনের জন্য, তেমনি বিশ্বের সর্বত্র পড়েছিল তার প্রভাব এবং আমরা পেয়েছি সব প্রান্তের সমর্থন ও সহায়তা। তাদেরই প্রতিনিধিদের মিলনমেলা বসেছে আমাদের রাজধানী ঢাকায়। এ বড় গৌরবের আয়োজন। দুঃসময়ের সুহৃদ ও বন্ধুদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এমন আয়োজন সচরাচর দেখা যায় না। তাদের সবাইকে অভিবাদন। আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে আবেদন, তাদের কাছ থেকে সবাই যেন যথাযথ প্রেরণা লাভ করে। বিশ্বের কোথাও যদি মানবতা লাঞ্ছিত হয়, গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাতের চেষ্টা হয়, স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যদি হুমকির সৃষ্টি হয় তা যেন দ্রুতই আমাদের বিবেককে জাগ্রত করে তোলে। একচলি্লশ বছর আগের তুলনায় বিশ্বে এখন সংবাদ আদান-প্রদান অনেক সহজ। মুহূর্তে যে কোনো সংবাদ পেঁৗছে যেতে পারে সর্বত্র। আমাদের প্রতিক্রিয়াও যেন হয় এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই_ অতি দ্রুত, যথাযথ ও ন্যায়সঙ্গত। একাত্তরের মতো পরিস্থিতি বিশ্বে আর কোথাও সৃষ্টি হোক, সেটা কাম্য নয়। কিন্তু বিশ্বে মুক্তির সংগ্রাম চলছে এবং চলবেই। আমাদের তার সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে এবং এটাই তো একাত্তরের শিক্ষা।

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
imtiazalter@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.