চারদিক-বঙ্গবন্ধুর চিঠি ও একজন ফরিজা by কেয়া চৌধুরী

একটি চিঠি সঙ্গী ফরিজার। আর সঙ্গী একটি বাঁশের লাঠি। লাঠিতে ভর করে এপাড়া-ওপাড়া ঘুরে বেড়ান আর মাঝে মাঝেই শাড়ির আঁচল থেকে চিঠিটা বের করে দেখেন। ‘প্রিয় বোন, আপনি দেশপ্রেমের সুমহান আদর্শ ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার মুক্তিসংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে পাক হানাদার দস্যুবাহিনীর হাতে...।


’ ছানিপড়া ঝাপসা চোখ আরও ঝাপসা হয়ে ওঠে তাঁর। নিজেকে সামলানো কষ্টকর হয়, তবু ঝাপসা চোখ ঠিকই খুঁজে নেন ৪০ বছর আগের এক রোদজ্বলা দুপুর।
সেই রোদপোড়া দুপুরে বান্ধবী আঙ্গুরার হাত ধরে আর দশ দিনের মতোই মক্তবে গিয়েছিল আট বছরের ফরিজা খাতুন। ততক্ষণে অবশ্য মক্তবঘর মুখর করে তুলেছিল অন্য সব বান্ধবী। তারা সুর করে আমপারা পড়ছিল কারি কাদির মিয়ার নেতৃত্বে। তৎকালীন হবিগঞ্জ মহকুমার (এখন হবিগঞ্জ জেলা) হলদারপুর গ্রামের সেই মক্তবে প্রতিদিন বাল্যশিক্ষার পাঠ নিত তারা। ফরিজা দ্রুত তাদের কাতারে বসতে বসতে দেখে নিয়েছিল বাইরে উজ্জ্বল রোদ, পাখির কূজন... অতি সাধারণ একটি দিন। শুধু বুঝতে পারেনি, এই সাধারণ দিনটিই তার সারা জীবনের জন্য অক্ষয় হয়ে থাকবে! দিনটি ছিল একাত্তরের ১৯ এপ্রিল।
সেদিন অকস্মাৎ বিমান শেলিংয়ের শব্দে শিশুপাঠ থেমে গিয়েছিল ফরিজাদের। তারপর কিছু না বুঝেই দৌড় শুরু করেছিল যে যার মতো। জীবন বাঁচাতে ফরিজা ও আঙ্গুরা আশ্রয় নিয়েছিল এক লন্ডনিবাড়ির পালঙ্কের নিচে। ঠিক তখনই আবার বিকট শব্দে বিমান শেলিংয়ের শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফরিজা দেখল আঙ্গুরার নিথর দেহ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। তারপর দেখল তার নিজের ডান পা-ও হাঁটুর নিচ থেকে নেই! কেবল রক্ত আর রক্ত! এক পলক দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ফরিজা। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখল তার ডান পা চিরতরে কেটে ফেলেছেন ডাক্তার। ফরিজা আরও জানান, সেদিনের বিমান শেলিংয়ে নিহত হয়েছেন মকবুল নেছা, আমিনা খাতুন, তৈয়াব চান, সোনার মা, পরপচান বিবি, ফজল মিয়া, লাল বিবি, গৌররানী বৈদ্য, বাসন্তী বৈদ্য, আসিনা বিবি ও কমলা বিবি। আর মারাত্মক আহত হয়েছিলেন মমতাজ বেগম, মনোহর মিয়া, শারমান বিবি, আশরাফ আলী, আমিনা খাতুন, শফিক মিয়া, রেজিয়া খাতুন, এখলাস বিবি, আজগর আলী, খোদেজা বিবি ও লতিফা খাতুন।
তারপর কেটে গেছে অনেক অনেক দিন। এক পা নিয়ে ফরিজার বয়স আজ ৪৯। সময়ের আঁচড় পড়েছে চেহারায়। অর্ধাহার-অনাহারে শরীর হয়েছে হাড়গোড়ের খাঁচা। পাবিহীন ফরিজাকে নিয়ে সংসার বাঁধতে আগ্রহী হয়নি কেউ। দরিদ্র বাবা যত দিন বেঁচে ছিলেন, দেখভাল করেছেন। আজ মা-বাবা দুজনই পরপারে। একজন ভাই আছেন বটে, কিন্তু তিনিও দিনমজুর। নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম অবস্থা। কীভাবে সাহায্যের হাত বাড়াবেন ফরিজার দিকে? তা ছাড়া লেখাপড়া জানা, অর্থবিত্তে সচ্ছল সে রকম কোনো আপনজনও নেই তাঁর। নেই সে রকম কোনো প্রতিবেশীও, যিনি ফরিজার পাশে এসে দাঁড়াতে পারেন। তাই দারিদ্র্যই এখন নিত্যসঙ্গী তাঁর। সঙ্গী একটি বাঁশের লাঠি এবং সঙ্গী হলুদ, স্যাঁতসেঁতে, লোনাধরা, বিবর্ণ এক চিঠি।
চিঠিটা পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু যখন কাজ শুরু করলেন, তখন ফরিজাকে স্বস্বাক্ষরিত এ চিঠিটি দিয়েছিলেন। সঙ্গে দিয়েছিলেন এক হাজার টাকার সরকারি অনুদান। তারপর অদ্যাবধি কেউ আর খোঁজ নেয়নি ফরিজার—না সরকার, না অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে। শুধু ‘চেতনায় ৭১ হবিগঞ্জ’ সংগঠনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর থেকে ‘প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র’ কর্তৃক প্রতি তিন মাস অন্তর তিন হাজার (মাসে এক হাজার টাকা হিসাবে) টাকা অনুদান পান ফরিজা। এর বাইরে আজ পর্যন্ত আর কোনো সাহায্য পাননি। এ জন্য যে খুব বেশি খেদ ফরিজার মনে তা নয়; বরং তার চেয়ে বেশি খেদ তাঁর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায়। তিনি জানেন না, একজন একাত্তরে পঙ্গু হওয়া মানুষ মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পেতে পারেন কি না। কিন্তু তাঁকে তো একটু সম্মান দিতে পারে সরকার। ফরিজা তাই আক্ষেপ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্বীকৃতি দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর বেটি কেন স্বীকৃতি দেবেন না?’
ফরিজা কঙ্কালসার দেহ নিয়ে লাঠির ওপর ভর করে সমাজের কর্তাব্যক্তিদের দুয়ারে দুয়ারে ধরনা দিচ্ছেন একটুখানি সাহায্যের আশায়। কিন্তু তাঁর আশার গুড়ে বরাবরের মতোই বালি পড়ছে।
কেয়া চৌধুরী
kchowdhuৎy71@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.