সাফল্যটা উপমহাদেশেরই-বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১

ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক আশীষ নন্দী বলেছিলেন, ক্রিকেট আসলে ভারতীয় খেলা, দুর্ঘটনাবশত যা ইংরেজরা আবিষ্কার করেছিল। সেই কথাই বুঝি সত্য হলো বিশ্বকাপ মহাকাব্যের সেমিফাইনাল থেকে ফাইনাল পর্বে। তিন ক্রিকেটীয় পরাশক্তি—পাকিস্তান আর ভারতের মহারণের শেষে বিশ্ব উপভোগ করল শ্রীলঙ্কা আর ভারতের মহাকাব্যিক লড়াই।


এবং এই লড়াই রাম-রাবণের মতো পারস্পরিক অশ্রদ্ধার নয়, অর্জুন আর কর্ণের মধ্যকার নীতির লড়াই। দুজনই বীর—একজন জয়ী, অন্যজন ট্র্যাজিক। বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১১-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত আজ মহাভারতের যুদ্ধজয়ী বীর পাণ্ডবকুল শিরোমণি অর্জুনের মতোই গরীয়ান, আর রানার্সআপ শ্রীলঙ্কা অঙ্কের হিসাবে পরাজিত হয়েও খেলার মানদণ্ডে কৌরবকুল নক্ষত্র কর্ণের মতোই পরাজিত কিন্তু মহীয়ান। অভিনন্দন জয়ী ভারতীয় ক্রিকেট দলকে, আর সহমর্মিতা জয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলকে। অভিনন্দন উপমহাদেশের প্রাণবান ক্রিকেট দর্শকদেরও, যারা স্টেডিয়ামে বা টেলিভিশনের সামনে বসে মাঠের খেলাকে সার্থক করে তুলেছিল, মেতে উঠেছিল ক্রিকেটের সর্বজনীন উৎসবে।
বলতে গেলে কোনো অঘটন ছাড়াই এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট শেষ হলো। রেখে গেল আনন্দ-বেদনার বর্ণিল রংধনুর স্মৃতি। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সার্থক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখে কেবল সাধারণ দর্শকেরাই নয়, ক্রিকইনফোর মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মন্তব্য করেছিল, বাংলাদেশ ক্রিকেটকে তার প্রাণ ফিরিয়ে দিল। ঢাকার সেই উৎসবমুখর শুরু শ্রীলঙ্কা হয়ে ভারতের ওয়াংখেড়ের স্টেডিয়ামে উৎসবের আমেজেই শেষ হওয়া কম কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, যে বিশ্বকাপের খাতিরে এত আয়োজন, এত উন্মাদনা, সেই বিশ্বকাপ এবার ভারতেই রয়ে গেল। যোগ্যতমের বিজয়ে কারও অগৌরব নেই, শক্তিমানের প্রতিদ্বন্দ্বিতাও উপভোগ্য। বাকিটা ভাগ্যের অনিশ্চয়তা এবং ক্রিকেট সেই অনিশ্চয়তারই খেলা। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, শেষ পর্যন্ত সামর্থ্য, অধ্যবসায় ও পরিশ্রম এবং নেতৃত্বের গুণেই জয় নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশের মতো নবীন ক্রিকেট দলের এ থেকে শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে। একই সঙ্গে এটাও বলা দরকার, এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটামোদীরা অনেক দুঃখের মধ্যেও অনেক আনন্দও পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্জিত জয়গুলো তাই ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে থাক, পরাজয়গুলো দিক শিক্ষা।
এবারের বিশ্বকাপ অনন্য কেবল খেলার গুণেই নয়, প্রযুক্তির জাদুতেও। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শূন্যে ক্রিকেট খেলা প্রদর্শনের অভিনব অভিজ্ঞতার কথাই বলি, আর টেলিভিশনে সম্প্রচারে ক্যামেরার কাজ, প্রযুক্তির চোখের নিবিড় নজর, ধারাভাষ্য—সবই মুগ্ধ করার মতো।
সবচেয়ে দৃষ্টিসুখকর ছিল ভারত-পাকিস্তানের সেমিফাইনালে দুই দেশের সরকারপ্রধানের পাশাপাশি বসে খেলা দেখা, সেই দৃশ্য বন্ধুত্বের। শুধু তা-ই নয়, চিরবিবাদী দুটি দেশের দর্শকেরাও কিন্তু এক গ্যালারিতে পাশাপাশি বসে খেলা উপভোগ করেছেন। গ্যালারিতে যাঁরা বন্ধুত্ব দেখাতে পারেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তাঁদের বন্ধুতা হতে অসুবিধা কী? ক্রিকেটের জানালা দিয়ে যে আলো এসেছে, সেই আলো যাতে উপমহাদেশীয় ভ্রাতৃত্ব আরও উদ্ভাসিত করে, সেই আশায় আমরাও বুক বাঁধি।
সব মিলিয়ে যাকে বলে মধুরেণসমাপয়েত তথা মধুর সমাপ্তি, এবারের বিশ্বকাপ তা-ই হতে পারল। তাই, ক্রিকেটকে অভিবাদন।

No comments

Powered by Blogger.