অরণ্যে রোদন-বিরল অর্জন, বিশাল সংবর্ধনা, বিকট জট by আনিসুল হক

‘সংবর্ধনা’ শব্দটির অর্থ বাংলা একাডেমী অভিধানে দেখতে পাচ্ছি: ১ অতি বৃদ্ধি; বাড়ানো। ২ সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা, সম্মাননা। সংবর্ধনা কথাটার মধ্যেই বাড়াবাড়ি আছে। কাউকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হবে, ধরেই নেওয়া যায়, অতীব বাড়াবাড়ি করা হবে। তিলকে তাল করা হবে তো বটেই, পারলে তিলকে চালকুমড়া করা হবে। বেগম খালেদা জিয়া


যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করে ফিরছেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি নাকি এক বিরল সম্মান অর্জন করেছেন। কী সেটা? একটা রাজ্য, নিউ জার্সির সিনেটের সভায় তিনি যোগ দেন এবং সেই সিনেটের অধিবেশনে ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন ও সন্ত্রাস দমনে খালেদা জিয়ার অবদান’-এর জন্য তাঁকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন কিংবা যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে দলের চেয়ারপারসনের সাক্ষাৎ না ঘটায় নেতা-কর্মীদের হতাশার পটে আমেরিকার একটা ‘রাজ্যের’ সিনেট সভায় যোগ দেওয়াটা নিশ্চয়ই খুবই সম্মানের ব্যাপার। কিন্তু সেটা কি এত বড় সম্মানের যে তাঁকে ‘বিশাল সম্মাননা’ দিতে হবে? আমরা সবাই জানি, নেতা-নেত্রীরা বিদেশ থেকে ফিরে এলে বিমানবন্দরে জনতার ভিড় লাগিয়ে দেওয়া আমাদের একটা চিরাচরিত রাজনৈতিক কর্মসূচি, এটা একেবারেই ‘রুটিন কর্মসূচি’। কাজেই নেতা বা নেত্রী বিদেশে কী কী অর্জন করেছেন, সেটা মোটেও বিবেচ্য নয়; কত বেশিসংখ্যক মানুষকে জড়ো করা গেল বিমানবন্দরে ও সড়কে, সেইটাই বড় কথা। এসবের মাধ্যমে দলের শক্তি প্রদর্শিত হয়, নেতা বা নেত্রী কত জনপ্রিয়, সেটা দেশবাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই শক্তির আঁচ প্রতিপক্ষকে টের পাইয়ে দেওয়া যায়। এ ধরনের সংবর্ধনা কেবল খালেদা জিয়া একাই লাভ করেন তা নয়, অন্য নেতা-নেত্রীরাও অতীতে লাভ করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার ফরাসি দেশ থেকে যে একটা নতুন ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছেন, সে উপলক্ষে বিমানবন্দরে সংবর্ধনা হতে না দেওয়ার মতো বিরল ঘটনা কেন ঘটল, আমরা জানি না। শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী নাকি নিজেই বারণ করে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনার জন্য এটা হয়তো একটা ছোট্ট ত্যাগ স্বীকার, কিন্তু নগরবাসী আমজনতার জন্য এটা যে একটা বড় স্বস্তি, তা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত সর্বশেষ সংবর্ধনার দিনটিকে যানজটে নাকাল ভুক্তভোগীরা বহুদিন পর্যন্ত মনে রাখবেন। শেখ হাসিনা এবার সংবর্ধনা না নেওয়ার জন্য আমাদের কাছ থেকে একটা বিশাল ধন্যবাদ পেতে পারেন।
২৯ মে ২০১১ সালে বেগম জিয়ার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনার ফলটা কী রকম ফলল? অন্য কোনো পত্রিকা নয়, আমার দেশ পত্রিকা লিখেছে, ‘পায়ে হাঁটার গতিতে গাড়ি ছুটে চলে গুলশানের দিকে। বিমানবন্দর থেকে জিয়া কলোনি-সংলগ্ন রেললাইন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার গাড়িবহর আসতেই সময় লাগে দুই ঘণ্টা। পাঁচটা ৪২ মিনিটের দিকে বিমানবন্দর থেকে গাড়ি চলতে শুরু করলেও সড়কের দুই পাশে দাঁড়ানো নেতা-কর্মীদের শুভেচ্ছার জবাব দিতে দিতে সামনে এগিয়ে চলে তাঁর গাড়িবহর। খিলক্ষেত, বিশ্বরোড, র্যাডিসন, জিয়া কলোনি হয়ে বেগম জিয়ার বাসভবনে পৌঁছে রাত পৌনে আটটার দিকে। এতে পুরো রাজধানী কয়েক ঘণ্টার যানজটে পড়ে যায়। কর্মস্থল-ফেরত হাজার হাজার মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। রাত ১১টা পর্যন্ত ব্যাপক যানজট ছিল ঢাকা শহরে।’ (দৈনিক আমার দেশ, ৩০ মে, ২০১১)
এই কৌতুকটি আপনাদের জানা। রাজা বেরিয়েছেন প্রাতর্ভ্রমণে। পথে দেখা এক কৃষকের সঙ্গে। ফেরার পর রাজার প্রাতরাশে পড়ল একটা মাছি। রাজা বললেন, সকালে কার মুখ দেখেছি যে আজ আমার এই দুর্ভোগ? কে সেই অপয়া? ধরে আনা হলো সেই কৃষককে। তার মুখ দেখেছিলেন বলেই রাজার পাতে মাছি পড়েছে। গোপাল ভাঁড় দেখা করলেন কৃষকের সঙ্গে, তাকে শিখিয়ে দিলেন উকিলি বুদ্ধি। কৃষক বলল, মহারাজ, আমি বড় অপয়া। সকালবেলা আমার মুখ দেখেছিলেন বলে আপনার পাতে মাছি পড়েছে। আর আজ সকালে আমি দেখেছিলাম আপনার মুখ। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এখন ভেবে দেখুন, কে বেশি অপয়া?
গত পরশু যাঁরা বিমানবন্দর সড়কটি ব্যবহার করতে গিয়ে বেগম জিয়ার সংবর্ধনাজনিত ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন, এই ক্ষুদ্র নাগরিক তাঁদেরই একজন। উত্তরায় একটা স্কুলে আয়োজিত এক বইমেলা থেকে আমরা বেরিয়েছিলাম সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়। কিন্তু ওই স্কুলের গেট থেকেই বেরোনো যাচ্ছিল না। তাকিয়ে দেখি, বিমানবন্দরগামী সড়কটিতে যানবাহন স্থির হয়ে আছে দুষ্ট জাদুকরের হাতের ছোঁয়ায় পাথরে পরিণত হওয়া নগরের মতো। ঘণ্টা আধেক ঠায় গাড়ির ভেতরে বসে থেকে আমাদের হুঁশ হয় যে এই সময় বেগম জিয়া বেরোতে পারেন বিমানবন্দর থেকে, কাজেই অনড়-অচল গাড়িতে বসে থাকার কোনো মানে হয় না। আমরা একটা খাবারঘরে আশ্রয় নিই। পৌনে আটটার দিকে সেখান থেকে বেরিয়ে উত্তরার ভেতরের পথ-উপপথ বেয়ে বিমানবন্দর থেকে দক্ষিণমুখী লেনে উঠে পড়তে সক্ষম হই। এর পরে যা দেখি, তা ভাষায় প্রকাশ করাই অসম্ভব। আমরা বাঁয়ের লেন ধরে ঢাকার দিকে যাব বলে যানজটে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু বহুসংখ্যক গাড়ি ডান পাশের লেন ধরে উল্টো দিক দিয়ে ঢাকার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে গোদের ওপর বিষফোড়া সৃষ্টি করেছে। কারণ তাদের বিপরীত দিক থেকে উত্তরমুখী যানবাহন আসছে। একই লেনে ঢাকামুখী ও ঢাকাত্যাগী যানবাহনগুলো মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ায় ‘বোতলবন্দী’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের ডান পাশের লেনে কোনো কিছুই নড়ছে না। আমাদের লেনটা তবু নড়ছে। আমরা সঠিক লেনে থাকায় শম্বুকগতিতে হলেও চলতে পারছি। যাঁরা ‘রং সাইড’ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেছেন, তাঁরা কেবল নিজেরা আটকা পড়েছেন তা-ই নয়, বিপরীত দিক থেকে ‘রাইট সাইড’ দিয়ে আসা যানবাহনগুলোকেও যেন চিরতরে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সততাই যে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা, তা পুনর্বার উপলব্ধি করতে পারলাম। নিজেরা তো ক্রমে ক্রমে এগিয়ে চলেছি, কিন্তু কী হবে তাঁদের, যাঁরা বেরিয়েছিলেন বিমানবন্দরে বিমান ধরবেন বলে? দেখলাম, বাসযাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে অধৈর্য হয়ে বাস থেকে নেমে পড়ছে, এদের মধ্যে নারী-শিশুও আছে। এরা কী করে বিমানবন্দর সড়কের বুক পরিমাণ উঁচু সড়ক বিভাজকটা পার হবে, কে জানে! কয়েকজনকে দেখলাম বড় বড় সুটকেস হাতে করে পায়ে হেঁটে বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে বিদেশিও আছেন। যানজটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সও আটকা পড়ে কাতর স্বরে কাঁদছে। আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, আমরা সাড়ে নয়টার দিকে ধানমন্ডিতে পৌঁছাতে পেরেছি, কিন্তু আমার দেশ পত্রিকাই লিখেছে, রাত ১১টা পর্যন্ত এই যানজট ছিল।
রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য। রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়, নীতির রাজা। রাজপথ মানেও রাজার পথ নয়, পথের রাজা। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কারণ ঘটে, এমন কর্মসূচি কি না দিলেই নয়? সংবর্ধনা তো একটা বিলাসী কর্মসূচি, তাতে কার কী লাভ হয়? এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে যে রাজনৈতিক দলগুলোকে অনেক টাকা-পয়সা জোগাড় করতে হয়, আর খরচও করতে হয়, সেটাও আমরা জানি। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। মানুষের শ্রমঘণ্টা অপচয়িত হয়, রাস্তায় জ্বালানি পোড়ে, বাতাস আরেকটু দূষিত হয়; কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট হয়। যে রোগী আটকা পড়েছেন অ্যাম্বুলেন্সে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে যাঁর পথে, তাঁর কথা আর তাঁর স্বজনদের কথা একবার ভাবার সময় কি জনসেবকদের হবে? হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ—এ ধরনের কর্মসূচিমাত্রই ভোগান্তিকর। সরকারের অন্যায়, ভুলত্রুটির নিশ্চয়ই সমালোচনা করতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রয়োজনে প্রতিরোধও করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা মানুষকে না ভুগিয়ে করার কথা কেউ কি ভাববেন? সবচেয়ে ভালো হলো জাতীয় সংসদে যোগ দেওয়া। সংসদে গিয়ে সরকারের তীব্র সমালোচনা করা। ওয়াকআউট করা। তাতে আমরা রাস্তাঘাটে একটু নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারি। এমনিতেই কোনো উপলক্ষ ছাড়াই যানজটে নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ। তার ওপর যদি নেতা-নেত্রীরা বিদেশে কোনো রাজ্যের সিনেট সভায় যোগ দেওয়াকে উদ্যাপনযোগ্য সাফল্য বলে ভাবতে থাকেন, তাহলে আমরা যাই কই? বিগত দুই দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, মানুষ হরতাল-অবরোধের জন্য বিরোধী দলকে পরবর্তী নির্বাচনের সময় ভোট দেননি; ভোট দিয়েছেন সরকারের ব্যর্থতা, সরকারি দলের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ হিসেবে। নব্বইয়ের পরে চারবার তা-ই ঘটেছে। চুপচাপ বসে থাকলেও ভোট পাওয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, যে জনতা এই সংবর্ধনাজাতীয় কর্মসূচিতে চরম দুর্ভোগের শিকার হন, তাঁদের ভোটেই ক্ষমতার বদল ঘটে। নেতা-কর্মীরা তো বাঁধা ভোটার। তাঁদের ভোট দুই বড় দল সব সময়ই লাভ করে। নীরব ভোটার, যাঁরা একবার এ-পক্ষে, আরেকবার ও-পক্ষে যান, তাঁরাই নির্ধারণ করেন ক্ষমতায় কে বসবে। এবং এই প্রসঙ্গে এ কথাও বলাটা জরুরি যে বিদেশিরা এই দেশের ক্ষমতার নিয়ামক নয়। তাদের কাছে ধরনা দিয়ে কোনো লাভ নেই। তবে ধরনা যে কেবল এইবারের বিরোধী দল প্রথম দিচ্ছে, তা নয়, এই ধরনা সব পক্ষই অতীতে বহুবার দিয়েছে, আওয়ামী লীগ তো দিয়েছেই। ক্ষমতার বাইরে থাকা একজন নাগরিক হিসেবে বলতে পারি, দেশের সাধারণ মানুষ বিদেশিদের কাছে বা বিদেশে গিয়ে দেশের বদনাম গাওয়াকে কখনোই পছন্দ করে না, সেটা আওয়ামী লীগ করলেও না, বিএনপি করলেও না। দেশের ভোটারদের একটা আত্মসম্মানবোধ আছে, তাঁরা এই সম্মানটুকুকে খুবই মূল্যবান মনে করেন যে আমার ভোটে ক্ষমতা নির্ধারিত হয়, বিদেশিদের অঙ্গুলি হেলনে নয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.