তামাকমুক্ত দিবস-তামাকের বিপদ উত্তরণের উপায় by নূরুল ইসলাম

প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকের প্রতিপাদ্য ছিল ‘তামাকের বিপদ: উত্তরণের উপায়’। সময় ও যুগের প্রেক্ষাপটে এ প্রতিপাদ্য উপযুক্ত ও নিতান্ত সঠিক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে হয়, প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে তামাক ব্যবহারের ভুক্তভোগীদের সঠিক আলো দেখানো হলো।


সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পেরে আয়োজকদের সঙ্গে আলাপ করে বিষয় ঠিক করা হলো। কিছু না কিছু প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনুসরণ করলে কৃতার্থ হব। সহজ কথা সহজভাবে বললে সহজ হয়ে যায়, যার কারণে পাঠক হয়ে পড়েন সৌভাগ্যের অধিকারী।
প্রথমেই বলা যায় তামাকের বিপদ কী কী?
এর জবাব এককথায় বলা যায়, তামাকের ব্যবহারে সবকিছুই বিপদ, সবই বিপদ। প্রতিটি টানে চার হাজার বিষাক্ত পদার্থ ফুসফুস থেকে আমাদের রক্তে সঞ্চালিত হয়ে শরীরের প্রতিটি অংশে ছড়িয়ে পড়ে বিষের সৃষ্টি করে। মস্তিষ্কে কিংবা পায়ে প্রতিটি অঙ্গে এর বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। রক্তে ছড়িয়ে পড়ার ফলে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনো অংশ বা অঙ্গ বিপদমুক্ত থাকতে পারে না। যে কারণে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ থেকে পায়ে পচন ধরতে পারে। ফুসফুসের ক্যানসার শতকরা ৮০ ভাগ ধূমপানের কারণে হয়ে থাকে। হার্টের রক্ত সঞ্চালনে বাধা সৃষ্টি হওয়ার কারণে হূদেরাগের আশঙ্কা থাকে। পেটে আলসার, একই কারণে পায়ে গ্যাংগ্রিন বা পচন হতে পারে। আলসার নিবারণ বিলম্বিত হয়। কিডনি বা মূত্রকোষে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।
ধূমপান প্রতিষ্ঠিত হত্যাকারী, এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। সারা বিশ্বের হাজারের ঊর্ধ্বে গবেষণা আছে, যাতে এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়, ধূমপান এবং তামাকের ব্যবহার ক্যানসারের জন্ম দেয়। বিষপানের বিপদ সীমাবদ্ধ। যিনি ধূমপান করেন তিনি নিজের সর্বনাশ ডেকে আনেন এবং অকালমৃত্যুর নামে আত্মহত্যা করেন। বিষপানকারী নিজে নিজের মৃত্যু ঘটান। কিন্তু ধূমপায়ী শুধু নিজের নন, তিনি তাঁর নিজের সন্তানদের দূষিত করার পাশাপাশি আশপাশে অবস্থানকারী সবাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও দূষিত বায়ু গ্রহণ করার কারণে এর বিষের শিকার হয়ে যায়। তাই আমরা ধূমপায়ীদের বলি, বায়ু দূষিত হওয়ার ফলে আশপাশের লোকেরাও পরোক্ষ বা অনিচ্ছুক ধূমপায়ী হয়। ধূমপায়ী ও অধূমপায়ী উভয়ের ওপর ধূমপানের বিষক্রিয়া সমান। অতএব বিষপানে আত্মহত্যা যিনি করেন, তাঁর মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু ধূমপানের পরিবেশে যারা বাস করে, যেমন—বাড়িতে, দোকানে, বাজারে, কর্মস্থলে কিংবা বাসস্থানে যেখানেই হোক না কেন, অধূমপায়ীরা অনিচ্ছুক ধূমপানের ফলে একই বিষের কবলে পড়ে ভুক্তভোগী হয়, যাকে বলা যেতে পারে নরহত্যা। অতএব ধূমপান বিষপানের চেয়েও ভয়ংকর। সারা বিশ্বে প্রতিবছর ধূমপানের ফলে পাঁচ লাখ লোক অকালে মারা যায়।
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, স্কুলজীবনের সপ্তম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্ররা ধূমপানে প্রথম আকৃষ্ট হয়। বিশেষ করে ক্লাসের ধূমপায়ী বন্ধুদের প্রভাবে তারা সিগারেট হাতে তুলে নেয়। জীবনের প্রথম সিগারেট শেষ পর্যন্ত নেশায় পরিণত হয়। এমন ধূমপান বিপদ টেনে আনে।
ধূমপানের উপকারিতা বলতে একেবারে কিছুই নেই। প্রতিটি ধূমপানের টানে চার হাজার বিষাক্ত পদার্থ মানুষের রক্তে প্রবেশ করে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩০টি বিষাক্ত পদার্থ শরীরে ক্যানসার সৃষ্টি করতে সক্ষম।
গর্ভবতী মায়ের ধূমপান গর্ভজাত শিশুর মৃত্যু ঘটায়। জন্মের পর অকালমৃত্যু হয়। মা-বাবার ধূমপানের ফলে জন্মলাভের প্রথম বছরে অনেক শিশু নানা সংক্রমণের ফলে অকালে মৃত্যুবরণ করে। অতএব এসব বিপদ থেকে শিশু, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী সবাইকে রক্ষা করতে হবে। এর শ্রেষ্ঠ উপায় নিজেকে ধূমপান থেকে মুক্ত রাখা, পরোক্ষ ধূমপান থেকে জনগণকে রক্ষা করা।
আমার মতে, শুরুতেই সতর্ক হয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে স্বল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের ধূমপানের বিপদ থেকে মুক্ত করা সম্ভব। আর মা-বাবার প্রতি অনুরোধ, অজাত শিশুর জীবননাশের জন্য তারা যেন জেনেশুনে বিষপান করবেন না।
অতএব, সবদিক দিয়ে বিচার করতে হবে, যা থেকে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের ধূমপান থেকে বিরত রাখা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কঠিন হওয়ার কথা নয়। এ বিষয়ে শিক্ষাদানে অথবা ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়।
ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে হারাম বলতে বোঝায় প্রতিটি ইমানদারের জন্য অবশ্যবর্জনীয় কিছু পানীয় খাবার। ধূমপানের ইতিহাস থেকে বোঝা যায় রাসুল (স.)-এর যুগে এমনকি তায়েবীর (রহ.) এবং আয়েমায়ে মুসতাহেদিনদের যুগেও আরবভূমিতে তামাকের অস্তিত্ব ছিল না। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাতেও তামাক কী জিনিস, কী রূপ অথবা ধূমপান সম্পর্কে কিছুই জানত না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৯২ ইংরেজির নভেম্বর মাসে কলম্বাস আমেরিকায় উপস্থিত হন। তখন তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা সেখানকার অধিবাসীদের সর্বপ্রথম ধূমপান করতে দেখেন। এরপর তিনি সুদূর আমেরিকা থেকে তামাকের চারা ইউরোপে আনেন। তারপর আস্তে আস্তে আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই তামাক চাষ চালু হয়ে যায়। এভাবে ধাপে ধাপে এক শতাব্দী থেকে আরেক শতাব্দীতে আরও জোরেশোরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তামাক চাষ ও ধূমপানের কু-অভ্যাস।
ডা. নূরুল ইসলাম: জাতীয় অধ্যাপক। আধূনিক-এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

No comments

Powered by Blogger.