সুনামি ও জ্যাঠামশায় by তারাপদ রায়

বিখ্যাত পাগলের বংশ আমাদের। এই খ্যাতি কতকাল আগে শুরু হয়েছিল, তা এখন আর জানা নেই, জানার উপায়ও নেই। তবে আমাদের বংশের এই পাগলামির খ্যাতি তুঙ্গে উঠেছিল জ্যাঠামশায়-এর আমলে। অমন অমায়িক, মিশুক, পরোপকারী পাগল আজকাল দেখা যায় না। তিনি নদীর ধারে রমণীদের স্নান করবার ঘাটে বসে থাকতেন।


তখন তাঁর যুবক বয়স। স্বনিযুক্ত প্রহরী নদীর ঘাটে স্নান করতে যাওয়া মহিলাদের পরিত্যক্ত বস্ত্রাদি পাহারা দিতেন, যাতে শ্রীকৃষ্ণ চুরি করে নিয়ে না যান।
তাঁকে প্রথম প্রথম বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের চরিত্র। সে এখন এই গণ্ডগ্রামে নদীর ঘাটে কোথা থেকে আসবে? এ তো বৃন্দাবন বা যমুনা নদী নয়।
জ্যাঠামশায়ের লেখাপড়ায় কমতি ছিল না। তিনি শ্রীকৃষ্ণের কথাই উদ্ধৃত করে বললেন, কৃষ্ণঠাকুর তো বলেই গেছেন, ‘সম্ভবামি যুগে যুগে।’ সুতরাং তিনি কখন অতর্কিতে আবির্ভূত হয়ে মহিলাদের বস্ত্রহরণ করে লজ্জায় ফেলবেন তার কিছু কেউই ঠিক বলতে পারবে না।
জ্যাঠামশায়ের ওজর-আপত্তি অবশ্য মহিলারা মেনে নেননি। তাঁরা এক রকম জোর করেই জ্যাঠামশায়কে স্নানের ঘাট থেকে তুলে দিয়েছিলেন। মনঃক্ষুণ্ন হয়ে জ্যাঠামশায় বাড়ি ফিরে এসে একটা সমাজসেবামূলক কাজের কথা ভাবলেন, যাতে কেউ আপত্তি করবে না। বরং সকলেরই উপকার হবে। সেকালে তো টিভি ছিল না, আবহাওয়া বার্তার জন্যে লোকে রেডিও শুনত। রেডিওতে আবহাওয়াবার্তা শুনে আর সকলের মতো জ্যাঠামশায়ের মনেও এই আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী বিষয় খটকা দেখা দিয়েছিল। অবশেষে তিনি নিজেই একটি আবহাওয়া অফিস স্থাপন করলেন। নিজের ঘরের সামনে পিচবোর্ডে মোটা করে কালি দিয়ে লিখে দিলেন—আবহাওয়া অফিস দিবারাত্র খোলা থাকে।
এ ব্যাপারে জ্যাঠামশায় একটি সরল যন্ত্র বানিয়েছিলেন। গজ তিনেক মেয়েদের চুল বাঁধবার লাল ফিতে ছাদের কার্নিশের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছিলেন। এটাই হলো আবহাওয়া যন্ত্র। এই যন্ত্রটির দ্বারা হাওয়া কোন দিকে বইছে এবং বৃষ্টি হচ্ছে কি হচ্ছে না, এই দুটি জরুরি তথ্য জানা যেত।
কোন দিকে হাওয়া হচ্ছে, জানা খুব সোজা। ছাদের থেকে ঝুলন্ত ফিতেটির দিকে তাকালেই দেখা যেত, হাওয়া কোন দিকে। যদি হাওয়া খুব নিস্তেজও থাকে, হালকা রেশমি রিবন যেদিক থেকে হাওয়া আসছে তার উলটো দিকেই উড়বে। সুতরাং এটা বলা কঠিন নয়। অসুবিধা ছিল বৃষ্টি হচ্ছে কি হচ্ছে না, বৃষ্টির মেঘলা দিনে ঘরের মধ্যে বসে সেটা বলে দেওয়া। তবে এই সমস্যার আশ্চর্য সমাধান করেছিলেন জ্যাঠামশায়। জানালা দিয়ে একটু হাত বাড়িয়ে সেই ফিতেটা ধরলেই হলো। যদি ফিতেটা শুকনো থাকে তাহলে বৃষ্টি হচ্ছে না, আর যদি ফিতেটা ভেজা থাকে তাহলে বৃষ্টি হচ্ছে বা হচ্ছিল। জ্যাঠামশায়ের কীর্তিকলাপ বলতে বলতে সুনামির ব্যাপারটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। এবার মূল ঘটনায় ফিরে যাচ্ছি।
আমাদের বালক কালে, সেই ১৯৫০ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল অসমে। গ্রামের পর গ্রাম, জঙ্গল, পাহাড়, জীবজন্তু, গাছপালা ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। জলের তোড়ে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, রেললাইন ভেসে গিয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র বাহিত হয়ে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল থেকে তিন-চারশো মাইল দূরে আমাদের এলাকাতেও নদীর স্রোতে ভেসে এসেছিল গাছপালা, জীবজন্তুর মৃতদেহ, মানুষের গলিত শবদেহ। বিপর্যয়ের গুরুত্ব দেখে সবাই ভাবিত হয়ে পড়েছিল।
এই সময় জ্যাঠামশায় কবুল করলেন, তাঁরই দোষে এই ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে; এ ব্যাপারে গাফিলতি সম্পূর্ণ তাঁর।
ক্রমশ জানা গেল, জ্যাঠামশায়ের ব্যাখ্যাতেই জানা গেল, গোলাকার পৃথিবী একটি সূক্ষ্ম কেন্দ্রবিন্দুর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ভারসাম্য বিন্দুমাত্র লঙ্ঘিত হলে পৃথিবী দুলতে থাকে। আর সেটাই হলো ভূমিকম্প।
আমাদের বৃদ্ধ মুহুরিবাবু বাসায় এই কথা শুনে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীকে মাথায় করে রেখেছেন নাগরাজ বাসুকি। তাঁর মাথায় একটু নাড়াচাড়া করলেই পৃথিবীতে ভূমিকম্প দেখা দেয়।’
জ্যাঠামশায় এক ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওসব বুজরুকি কথা সব জায়গায় বলবেন না। সব জায়গা আদালত নয়।’
সে যা হোক, অনতিবিলম্বে জ্যাঠামশায় অনেক রকম অঙ্ক কষে পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু নির্ণয় করে ফেলেছিলেন। সৌভাগ্যের কথা, সেই কেন্দ্রবিন্দুটি ছিল আমাদের বাড়ির কাছারিঘরের ঠিক পেছনে কাঁঠালতলায়। একটা পায়ে চলা পথের পাশে। আমাদের বাড়ির মধ্য থেকে পুকুরঘাটে এই পথ দিয়ে শর্টকাটে যাওয়া যায়। প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে, দিনের নানা সময়ে, এমনকি গভীর মধ্যরাতে জ্যাঠামশায় এই কেন্দ্রবিন্দুটি পর্যবেক্ষণে রাখতেন।
বলা বাহুল্য, জ্যাঠামশায় ছাড়া আর কেউ এই বিন্দুটি দেখতে পেত না। জ্যাঠামশায় একটা বড় জলভর্তি ভারী কাঁসার ঘড়া ওই বিন্দুর ওপর বসিয়ে রাখতেন। হঠাৎ নড়াচড়ার সম্ভাবনা দেখলে বিন্দুটিতে ঘড়াটি একটু এদিক-ওদিক করে বসিয়ে দিতেন। এই রকম যতক্ষণ না ভারসাম্য ফিরে আসে। এভাবে সযত্ন পর্যবেক্ষণ ও খুব কঠিন ধৈর্যের সঙ্গে জ্যাঠামশায় বহুদিন ভূমিকম্প ঠেকিয়ে রেখেছিলেন।
সত্যিই আর ভূমিকম্প হতো না। জ্যাঠামশায় অবশ্য তাঁর কার্যকলাপ থেকে বিরত হননি। তিনি হঠাৎ হঠাৎ উঠে গিয়ে কাঁঠালতলায় নির্দিষ্ট জায়গায় ঘড়াটি নড়িয়ে চড়িয়ে শেষরক্ষা করতেন। কখনও জল কমিয়ে বাড়িয়ে। একবার তো শেষ মুহূর্তে সম্পূর্ণ জল ফেলে দিয়ে ঘড়া শূন্য করে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন।
জ্যাঠামশায় মৃত্যুর আগে দাদাকে, একমাত্র দাদাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কেন্দ্রবিন্দুটি সঠিক কোথায়। এবং ঘড়াটির মালিকানা দাদাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। গোপনে বলে দিয়েছিলেন কীভাবে কেন্দ্রবিন্দুতে ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।
জ্যাঠামশায়ের মৃত্যুর পর দাদা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল জগৎ সংসারে ভূমিকম্প নিরোধ করতে। কিন্তু একবার কী যে কী হলো। একদিন শেষ রাতে পুকুরে স্নান করতে যাওয়ার সময় ঠাকুমা ওই ঘড়ায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়ে ভীষণভাবে আহত হলেন।
সেদিন বিকেলেই ঠাকুমা আমাদের মুহুরিবাবুকে দিয়ে ঘড়াটি নদীতে বিসর্জন দিলেন। ঘড়াটির ওপর ঠাকুমার যথেষ্ট ক্রোধ ছিল। জ্যাঠামশায়ের পাগলামি এই ঘড়ার জন্যই হয়েছে, এ বিষয়ে তাঁর বিশ্বাস প্রবল ছিল।
ইতিমধ্যে জ্যাঠামশায় পরলোকগমন করেছেন। দাদা কয়েকদিন মাটির হাঁড়িতে জল দিয়ে ভূমিকম্প নিবারণের আন্তরিক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু দাদা নিজেই দেশ ছেড়ে চলে এল। কাঁঠালতলায় পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুটি কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
আজ এই সুনামির দিনে বারবার আমাদের সেই পুরোনো বাড়ির কথা মনে পড়ে। জ্যাঠামশায়কে মনে পড়ে এবং মনে হয় কোথাও একটা বিন্দু আছে; সে বিন্দুর ওপরে সব ভারসাম্য রক্ষা হয়। কোনো পুরোনো বাড়ির ছায়াভরা কাঁঠালগাছের তলায় সেই আশ্চর্য বিন্দুটি এখনো রয়ে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.