গণহত্যা-ধর্ষণ অস্বীকার-শর্মিলা বোসের লাশগণনার ভুতুড়ে ইতিহাস by ফারুক ওয়াসিফ

তাহলে কি একাত্তরের সকল শহীদকেই বধ্যভূমি থেকে উঠে এসে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, এখানে একটি বিরাট গণহত্যা হয়েছিল এবং তাঁরা তার শিকার? ধর্ষণের শিকার নারীদেরই কি জানাতে হবে, একাত্তরজুড়ে কী সইতে হয়েছিল তাঁদের!
মুক্তিযুদ্ধের একাডেমিক ইতিহাসচর্চার খাতাটা প্রায় সাদাই ছিল অনেক দিন।


ভারতীয় ইতিহাসবিদ শর্মিলা বোস তাতে একটা কালো দাগ এঁকেছেন। তিনি বই লিখেছেন, ডেড রেকনিং: মেমরিজ অব দ্য নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান বাংলাদেশ ওয়ার বা মৃতশুমারি: ১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি। শুমারিটা কে করছে? স্মৃতিটা কার? শুমারির জন্য তিনি নির্ভর করেছেন পাকিস্তানি সেনাভাষ্যকে আর স্মৃতিটা প্রধানত তাদেরই। কারণ, যুদ্ধটা তাঁর কাছে প্রধানত ‘গৃহযুদ্ধ’ অথবা ভারত-পাকিস্তানের ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ’; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ নয়। তিনি রামকে বাদ দিয়ে রামায়ণের গল্প লিখতে বসেছেন। তাঁর বইয়ের নাম তাই দেওয়া যায় ‘মৃতশুমারি: হারানো বাংলাদেশের ভুতুড়ে স্মৃতি’।
অতীতের স্মৃতি ও ইতিহাস কারও মধ্যে চেতনা জাগায়, আবার কাউকে তা ভূতগ্রস্তের মতো তাড়িয়ে বেড়ায়। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান মরে গেছে একাত্তর সালেই, কিন্তু তার ভূত এখনো চেপে আছে কারও কারও ঘাড়ে। শর্মিলা বোস মনে হয় সেই ভূতগ্রস্তদেরই একজন। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের ভাষণে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদমসন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।...পূর্বপরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল, তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের মৃত্যু না হলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হতো না। যে বঙ্গীয় মুসলমানের আন্দোলন ও ভোটের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাদের বঞ্চিত ও হত্যা করে পাকিস্তান আত্মঘাতী হলো। ১৯৭১ সালে তাই পাকিস্তানের পূর্ব অংশেরই মৃত্যু ঘটেনি, মৃত্যু ঘটেছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ তথা দ্বিজাতিতত্ত্বেরও। রাষ্ট্রের আদর্শ বা চেতনা মারা গেলে তার শারীরিক মৃত্যুটা সময়ের ব্যাপার। সুকুমার রায় লিখেছিলেন, কোনো রামছাগলের সেজোমামার অর্ধেকটাকে কুমিরে খেল বলে বাকি অর্ধেকটা নাকি সেই দুঃখে মারাই গেল। অর্ধেক পাকিস্তানের মৃত্যুতে নেতাজি সুভাষ বোসের নাতনির দুঃখটাও বুঝি সে রকম!
গবেষক বা লেখকের কাজের একটা অভিপ্রায় বা উদ্দেশ্য থাকে। শর্মিলা বোসের অভিপ্রায় বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা ও তত্ত্বের খণ্ডন। তিনি আসলে একাত্তরের অ্যান্টিথিসিস বা পাল্টা তত্ত্ব রচনা করে যাচ্ছেন। ওয়াশিংটনে বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর উল্লিখিত একাত্তরের কিছু ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এসব ঘটনায় দুর্ঘটনাবশতভাবে ছাড়া সেনাবাহিনী নারীদের কোনো ক্ষতি করেনি।...পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নারী ও শিশুদের বাদ দিয়ে কেবল বয়স্ক পুরুষদের নিশানা করেছিল।’ এটা বলেছেন কয়েকটি ‘ঘটনার’ ব্যাপারে। এর পরই চলে যাচ্ছেন সিদ্ধান্তে, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অবস্থার সুযোগে করা সুবিধাবাদী যৌন অপরাধ বাদ দিলে, কোন মাত্রায় ধর্ষণ ঘটেছিল, কে কাকে শিকার করেছিল এবং সে সময় কোনো পক্ষ লাগাতারভাবে পরিকল্পনামাফিক ধর্ষণ চালিয়েছিল কি না, তা-ই প্রশ্ন।’ তাঁর সিদ্ধান্ত: সে রকম কিছু পাকিস্তানি বাহিনী করেনি।
তাঁর দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি গণহত্যা বিষয়ে। ‘অ্যানাটমি অব ভায়োলেন্স’ প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালের গৃহযুদ্ধে দুটি পক্ষ লড়েছিল, যাদের একপক্ষের বিশ্বাস তারা পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার জন্য লড়ছে, অন্য পক্ষ লড়েছে সুবিচারের সুযোগ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের উন্নতি হবে এমন বিশ্বাসে। উভয়ের অবস্থানই রাজনৈতিকভাবে বৈধ। উভয় পক্ষই সহিংসতার পথে সমাধান চেয়েছে, সবাই যুদ্ধের গৃহীত নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে নৃশংস কর্মকাণ্ড করেছে, এবং উভয়ই মানবতার অংশ। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অপরাধীকরণের (পাকিস্তানি সেনাদের) দাগ মেরে দেওয়ার বদলে বরং ১৯৭১-এর সংঘাত বিশেষভাবে সমঝোতা প্রয়াসের উপযোগী।’
অর্থাৎ তিনি পাকিস্তানের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে একভাবে দায়মুক্তি দিলেন এবং চাইলেন নিপীড়ক ও নির্যাতিতের মধ্যে, ঘাতক ও নিহতদের মধ্যে সখ্য স্থাপন করতে। কারণ, উভয় পক্ষই তো সমান দোষী! কারণ, যুদ্ধটা তো স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল না, ছিল ‘গৃহযুদ্ধ’। কারণ বাঙালিরা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কারণে নয়, কেবল ‘উন্নতির আশাতেই’ আলাদা হতে চেয়েছিল। আর তারাই তো ‘বিশৃঙ্খল’ অসহযোগ আন্দোলনে সহিংসতা ঘটিয়েছে, উসকানি দিয়েছে; তারাও নৃশংস কর্মকাণ্ড করেছে। এই যদি হয় ইতিহাস, তাহলে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ মিটমাট করে নেওয়াই ভালো! মনে রাখা দরকার, এই কথাগুলো বলেই পাকিস্তান ও তার এদেশীয় দোসরেরা যাবতীয় অনাচার করেছিল। এ জন্যই এক কথায়, তাঁর থিসিস একাত্তরের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকারের বুদ্ধিবৃত্তিক ফসল।
স্বাধীন-সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনাই একাত্তরের অভিজ্ঞতার প্রাণভোমরা। এটাই স্বাধীনতাসংগ্রামের রাজনৈতিক শাঁস। এই লক্ষ্যের কারণেই একাত্তরের প্রাণবিসর্জন ও নিপীড়নের অভিজ্ঞতা মহত্ত্ব পায়, নিহতদের আমরা শহীদ বলি। শর্মিলা বোসেরা এই রাজনীতির বৈধতা এবং শহীদদের মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তাঁর সমালোচনার তীর এভাবে একে একে স্বাধীনতা আন্দোলন ও তার আদর্শ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি, নিহত ও নির্যাতিতদের বিসর্জন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি—সবকিছুকেই ভেদ করতে চায়। তাঁর এই থিসিস তাই মুক্তিযুদ্ধের অ্যান্টিথিসিস। এখানেই তিনি একাত্তরে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষদের সঙ্গে একাত্ম। তিনি দিচ্ছেন নতুন সৃষ্টিতত্ত্ব বা জেনেসিস। এ জন্য তিনি সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও অরক্ষিত জায়গায় আঘাত করেছেন। জয়া চ্যাটার্জি বেঙ্গল ডিভাইডেড বইয়ে ১৯৪৭-এর বঙ্গভাগের জন্য হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে দায়ী করে ১৯৪৭-এর দেশভাগের ভিন্ন তাৎপর্য দেন। শর্মিলা বোস করেন উল্টো কাজ। পাকিস্তান-ভাগের জন্য অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই তিনি অভিযুক্ত করেন। তাঁর লক্ষ্য ইতিহাস বদলানো। ইতিহাসকে ফ্যান্টাসি মনে করলেই এমন ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলা সম্ভব। তাঁর কাজ তাই জয়া চ্যাটার্জির বিপরীত। একটি ইতিহাস অন্যটি প্রতারণা।
ইতিহাস-লিখন অতিমাত্রায় রাজনৈতিক কাজ। উপমহাদেশে রাজনৈতিক সংঘাতের আগুন ইতিহাসের বিতর্ক থেকেই পর্যাপ্ত বারুদ পেয়ে আসছে। শর্মিলা বোস এখানে একা নন, খোদ পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র এবং একাত্তরের ঘাতকেরাও এখনো ভূতগ্রস্তের মতো বাস্তবতাকে অস্বীকার করে চলেছে। একাত্তরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার শিকার বিরাট এক জনগোষ্ঠী এখনো জীবিত। তাঁদের জীবদ্দশাতেই যদি এমন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে যখন তাঁরা থাকবেন না, তখন কী হবে? ৪০ বছর পরের পরিস্থিতি আসলেই ঘোলাটে হয়ে যেতে পারে। পরিবর্তমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে শর্মিলা বোসদের ইতিহাসের অ্যান্টিথিসিস, একাত্তরের রাজনৈতিক অ্যান্টিথিসিসেরও জমিন জোগাতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করে দলীয় ছাতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে, একাত্তরের জটিল ও গভীর খনিতে নামা প্রয়োজন। প্রয়োজন ইতিহাসের ঋণ ইতিহাস রচনার মাধ্যমেই শোধ করা। একদল তরুণ গবেষকই এ কাজে আগুয়ান থাকতে পারেন।
শর্মিলা বোস লিখেছেন, ‘বাংলাদেশিরা তাদের দেশের জন্ম নিয়ে উচ্ছ্বসিত, কিন্তু নিয়মসংগতভাবে ঐতিহাসিক রেকর্ড-রক্ষার কাজ তারা সামান্যই করেছে। এবং ১৯৭১ বিষয়ে ব্যাপক লেখালেখি হলেও তার বেশির ভাগই ভিত্তিহীন আবেগাক্রান্ত হওয়ার জন্য অগুরুত্বপূর্ণ।’ তাঁর অভিযোগ উদ্ধত হলেও অংশত সত্য। এখনো স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে রাজনৈতিক সমাজে সমঝোতা সৃষ্টি হয়নি। এটা যুদ্ধাপরাধীদের পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ বিচারেরও বাধা। এক পাকিস্তানি সেনা বলেছিল, ‘আমরা যাকে খুশি তাকে হত্যা করতে পারি, এর জন্য আমাদের কাউকে জবাবদিহি করতে হবে না।’ একাত্তরের পরে পাকিস্তান সরকারের হামুদুর রহমান কমিশনও লিখেছিল যে বাংলাদেশ যদি গণহত্যা ও ধর্ষণের উপযুক্ত প্রমাণ দিতে পারে, তাহলে বিবেচনা করা হবে। এসব নিপুণ প্রতারণার জবাব দিতে হলে ঠান্ডা মাথায় কিছু কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। একাত্তরের নথিবদ্ধ-দালিলিক প্রমাণের মহাফেজখানা সৃষ্টি, জনমানসে স্মৃতির পুনর্জাগরণ, শর্মিলা বোস কথিত ‘অশিক্ষিত’ বাঙালির মৌখিক সাক্ষ্য ধারণ এবং সরকারিভাবে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিষ্ঠাবান গবেষণা উৎসাহিত করতে হবে। একাত্তরের সাত কোটি মানুষের সাত কোটি কাহিনি ছিল, ছিল সাত কোটি স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন। তার প্রতি সুবিচার আমরাই কি করতে পেরেছি? সেই সব নির্যাতিত নারীকে কি আমরা সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম? না করলে অন্যদের কী ঠেকা? সেই কাজ এখনো বাকি। এখনো আমাদের ‘ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’।
গবেষণা ও ইতিহাসলিখন এবং বিচার ও শাস্তির প্রক্রিয়ায় যে ইতিহাস-চেতনা গঠিত হবে, সেটাই হবে মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক অবদানের স্বীকৃতি। জাতীয়ভাবে সব হত্যাকাণ্ডের বিবরণ ও সংখ্যাগণনা, সব বধ্যভূমি শনাক্তকরণ এবং ধর্ষণের শিকারদের সম্মান ও শান্তি বাঁচিয়ে তাদের ইতিহাসও তুলে আনতে হবে। তাতে যদি শহীদ ও নির্যাতিতার সংখ্যার উনিশ-বিশ হয়, তাতে ত্যাগ ও গৌরবের কমতি ঘটবে না। কারণ, সাগর সেঁচা যায় না। এই প্রক্রিয়ায় দু-একটা কালো দাগও যদি বেরিয়ে আসে, তাতেও বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এত বড় যুদ্ধ ও রক্তক্ষয় যারা পেরিয়ে এসেছে, তাদের আরও আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কথা। বাংলাদেশ যদি বিজয়ী হয়ে থাকে, তবে বিজয়ের পূর্ণাঙ্গ ও বহুমাত্রিক ইতিহাস তাকে লিখতেই হবে। একাত্তরকে গণতন্ত্রের যাত্রার মশাল বা দিশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে গ্রহণমুখী উদার মানসিকতাও জরুরি।
মুক্তিযুদ্ধে সবার ভূমিকার সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু শহীদদের প্রাণদান আর নির্যাতিতদের দুর্ভোগকে কোনোভাবেই বাতিল বা হেয় করা যায় না। তা রাজনীতির ঊর্ধ্বের বুনিয়াদি ঘটনা। ইতিহাস কারও কাছে চেতনা, কারও কাছে দুঃস্বপ্ন। চেতন মানুষ ইতিহাসকে জাগিয়ে রাখে, ভূতের মতো অতীতে বসত করে না। কিন্তু একাত্তরের পরাজয়ের ভূত এখনো অনেককে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নতুন প্রজন্ম একাত্তরের চেতনায় উদ্দীপিত হচ্ছে। একদিকে এই জাগর হওয়ার প্রক্রিয়া অন্যদিকে ভূতগ্রস্ততার বিকার; এই দুইয়ের লড়াই ইতিহাসচর্চার জমিনে এবং রাজনীতিতে আরও অনেক দিন চলবে। তার মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.