চারদিক-গানের মেলা প্রাণের মেলা by আকমল হোসেন

রাত ১০টার কাঁটা কখন পেরিয়ে গেছে, তবু আসন ছাড়ার নাম নেই কারও। সেই যে সন্ধ্যায় এসে আসন পেতেছেন, আর ওঠেননি—পরে এসে যদি আর আসনটি না পান! গানে গানে এমন করেই কেটেছে তিনটি সন্ধ্যা-রাত। আর গান বলতে সেই গান—একদম মাটির সোঁদা গন্ধমাখা, অন্তরের গান; যা এই অঞ্চলের জলবায়ুতে প্রাণ পাওয়া আউল-বাউলের গান।


বহু বছর ধরে যা সাধারণ মানুষের সরল আবেগ ছুঁয়ে আছে।
এ রকম গানেরই আয়োজন করেছিল মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসন তিন দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক মেলায়। লক্ষ্যটা এই অঞ্চলের গান, সংস্কৃতিকে মানুষের সামনে আরও একবার তুলে ধরা; যাতে মানুষ তার আপন মাটির গন্ধ নিতে পারে, প্রাণের গভীরে ঘুমিয়ে থাকা নিজেকে চিনতে পারে।
২৫ মে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সাইফুর রহমান মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী নজরুলজয়ন্তী ও সাংস্কৃতিক মেলার উদ্বোধন করেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ। সেদিন সন্ধ্যায় মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জাহানারা খাতুন ও সৈয়দ আবদুুল মুতাকাব্বীর মাসুদ। স্বাগত বক্তব্য দেন গণপরিষদ সদস্য ও সাবেক সাংসদ, অনুষ্ঠানের সমন্বয়ক আজিজুর রহমান। গান গেয়ে শোনান শিল্পী মফিজুর রহমান, জয়ন্তী লালা, ছায়া রায়, রনি প্রেন্টিস, তৃপ্তি চক্রবর্তী, রাজেশ সাহা, গৌতম মহারত্ন ও মীরা সিনহা। শিল্পীদের কণ্ঠে ছিল কাজী নজরুল ইসলামের দ্রোহ ও প্রেমের গান। পরদিন ২৬ মে ছিল ঘরের খবর নেওয়ার পালা। লোকজ বাংলায় হারিয়ে যেতে যেতেও যা এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, সেই গাজির গান গাইলেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার সোনা মিয়া ও তাঁর দল। কাহিনিনির্ভর এই পালা যখন রঙিন আলখাল্লায় মোড়ানো প্রধান শিল্পী নেচে নেচে বয়ান করেন, তাঁর সঙ্গে বাইন ধরেন সহশিল্পীরা—চলে কথার ফোড়ন। তখন সরল আনন্দে হেসে ওঠেন দর্শকেরা। একটা সময় কাজের অবসরে ঢোল-করতাল বাজিয়ে এ রকম গাজির গান প্রায় গ্রামের বাড়ির উঠোনে গাওয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ-শিশুরা সেই গানের দলটিকে ঘেরাও দিয়ে বসেছে। এই প্রাণ-ভরানো লোকজ উপাদানগুলো ক্রমেই যেন কালের পুরাণ হতে চলেছে। এরপর যখন শিল্পীরা গান ধরেন ‘লোকে বলে বলে রে ঘরবাড়ি ভালা নায় আমার’, কিংবা ‘রঙের বারই রঙের বারই রে/ বিষম ইন্দুরায় লাগাল পাইলো/ উগার ভরি থইলাম ধান/ খাইয়া তুষ বারাইল’, অথবা ‘ভ্রমর কইও গিয়া/ শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর কইও গিয়া’, তখন দর্শকেরা মনে না করে পারেন না, এই লোককবিরা তো তাঁদের ঘরেরই লোক। হাসন রাজা, রাধারমণ ও আরকুম শাহ—এঁদের গান শুনে শুনেই অনেকে বড় হয়েছেন। এদিন ছিল এই তিন শিল্পীর স্মরণে গান। গেয়ে শুনিয়েছেন শিল্পী আশিক, পংকজ দেব, বিন্দু বাবু, পুষ্পিতা দেব চম্পা ও আরও অনেক স্থানীয় শিল্পী। অনেক রাত পর্যন্ত চলে এই গান। তবে শিল্পীদের গানে যন্ত্রের উচ্চ বাদন অনেকের কান মেনে নিতে যেন এখনো প্রস্তুত নয়। অনেক দর্শকই এই লোককবিদের গান গানের স্রষ্টাদের মতো করে নরম, আদুরে, মাটির মমতার সুরে গাইবার কথা বলেন। একজন দর্শক মিলনায়তনের বাইরে এসে বলেন, ‘এই গানগুলো তো এ রকম গাওয়া ঠিক না। বাজনার জন্য কিছুই বোঝা যায় না। এই গানের শিল্পীরা তো দেশি যন্ত্রের সুরে গান গাইতেন। গানে মজা পাওয়া যেত।’
শেষ দিন ২৭ মে ছিল ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্র, কথা ও সুরের নানা আয়োজন। স্থানীয় একদল যন্ত্রবাদক দেশীয় যন্ত্র ঢোল, ঢপকি, করতাল, মৃদঙ্গ, বেহালা, বাঁশি ইত্যাদি বাজিয়ে মিলনায়তনে তৈরি করেন চিরচেনা বাংলার আমেজ। অনেক দর্শকই যেন ফিরে পেলেন তাঁদের ফেলে আসা শৈশব, কৈশোর, এমনকি কারও যৌবনের বাঁধনহারা সময়টিকে। যে সময় তাঁরা এই যন্ত্রের সঙ্গে কণ্ঠবাদনের অপূর্ব রসমাধুরী সঞ্চয় করেছিলেন। সবুজ বাংলা থিয়েটার মঞ্চস্থ করল নাটক। এর পরই শুরু হলো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের দুই কিংবদন্তি শিল্পীর গানের পরিবেশনা। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ‘হবিগঞ্জের জালালি কৈতর/ সুনামগঞ্জের কুড়া’ কিংবা শাহ আবদুল করিমের ‘গাড়ি চলে না চলে না/ চলে না রে, গাড়ি চলে না’—এমন অনেক গান। একে একে গাইলেন বাউল শিল্পী আবদুর রহমান, রণেশ ঠাকুর, আবু ইউছুফ, শাহীনুর ও মীরা সিনহা। গান চলছে তো চলছে, শ্রোতাও মিলনায়তন পূর্ণ করে বসে। বাইরেও অনেক শ্রোতা। মানুষের অন্তর নাড়ানো গান তখন ভেসে যাচ্ছে রাতের বুকে। রাত গভীর হচ্ছে, কিন্তু কারও যেন তৃষ্ণা মিটছে না। কেবল ঝোড়ো বাতাস যখন বিদ্যুতের আলো নিভিয়ে দিল, তখনই যেন সবার মনে পড়ল ঘরে ফেরার কথা। তখন সময় মধ্যরাতের কাছাকাছি।
আকমল হোসেন

No comments

Powered by Blogger.