সময়ের প্রেক্ষিত-জাপানের দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান by মনজুরুল হক

১১ মার্চের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প ও সুনামির জলোচ্ছ্বাস যে ছিল জাপানের স্মরণকালের সবচেয়ে বড় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সেই বাস্তবতা ইতিমধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রকাশ ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেছে। প্রাণহানির সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বড় যে দুর্যোগ জাপানকে এ পর্যন্ত সামাল দিতে হয়েছে, সেটা হচ্ছে ১৯২৩ সালের বিধ্বংসী কান্ত ভূমিকম্প;


টোকিও ও আশপাশের এলাকার ওপর আঘাত হানা ওই ভূমিকম্পে মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ধ্বংসাত্মক শক্তির মাত্রার দিক থেকে কান্ত ভূমিকম্পটি ছিল সর্বশেষ ভূমিকম্পের চেয়ে কিছুটা দুর্বল। তবে তা সত্ত্বেও প্রাণহানির সংখ্যা এত বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, সেই সময়ের বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনার ঝুঁকিপূর্ণ কাঠামো। ১৯২৩ সালের ভূমিকম্পে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল ভূমিকম্পের পর শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়া দাবানল, যা আয়ত্তে আনতে অনেক সময় লেগে যায়। সেবার অবশ্য ভূমিকম্পের পরপর সুনামি-জলোচ্ছ্বাসের আগমন ঘটেনি।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে নিহত ও নিখোঁজ লোকজনের মোট সংখ্যা ৩০ মার্চ দুপুর ১২টায় প্রচারিত সরকারি হিসাবে ২৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যার মধ্যে নিশ্চিত হতে পারা নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি। আগামী দিনগুলোয় এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এই যুগে জাপানের মতো অগ্রসর একটি দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এত প্রাণহানি নজিরবিহীন ঘটনা। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই সুনামির ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে চিরদিনের জন্য তলিয়ে গেছেন সাগরের গভীরে।
অন্যদিকে ভূমিকম্প ও সুনামির বাইরে অন্য যে তাণ্ডব ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে আসে, সেটি হলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা, যা সামাল দেওয়া এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বিধ্বংসী শক্তির তৃতীয় এই সর্বনাশা হামলার ব্যাপকতাও শেষ পর্যন্ত হয়তো সুদূরপ্রসারী হয়ে দেখা দিতে পারে। এর ক্ষয়ক্ষতির সার্বিক হিসাব সম্ভবত ভবিষ্যতে কোনো একসময় করা সম্ভব হবে। দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব এখন পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে, তার সবই হলো ভূমিকম্প ও সুনামিতে ভৌত কাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক মূল্যায়নের খতিয়ান।
জাপান সরকারের আনুমানিক এক হিসাবে বলা হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির সর্বিক পরিমাণ ২৫ লাখ কোটি ইয়েনে দাঁড়াতে পারে; ডলারের হিসাবে যা হবে ৩০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। সন্দেহ নেই, ক্ষতির এই বিরাট বোঝা কাটিয়ে ওঠা জাপানের পক্ষে মোটেও সহজ হবে না এবং তা দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব হয়তো ফেলবে। সরকারও সে রকম নেতিবাচক প্রভাবের সম্ভাবনাকে হিসাবে রেখেই বলছে, সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে দেশের এ বছরের প্রবৃদ্ধির হার প্রত্যাশিত হিসাবের চেয়ে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ নিচে নেমে যাবে। এসব হিসাব দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক মন্থরতা থেকে বের হয়ে আসার চিহ্নমাত্র দেখা দেওয়ার মুখে জাপানের জন্য নতুন করে সংকটে পতিত হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত হিসাবে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের যে মাশুল জাপানকে হয়তো শেষ পর্যন্ত দিতে হবে, তার মোট পরিমাণ সম্ভবত ১২ হাজার ২০০ কোটি থেকে ২৩ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের মধ্যে কোনো এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে। অন্য হিসাবে যা কিনা দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের আড়াই থেকে চার শতাংশ এবং এতে ২০১১ সালে জাপানের প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবার দেখা যাক অর্থনীতির কোন দিকগুলোতে ক্ষতির পরিমাণ চোখে পড়ার মতো হয়ে দেখা দিতে পারে।
সাম্প্রতিক দুর্যোগের কারণে জাপানের উৎপাদনশীলতা ইতিমধ্যে ক্ষতির হিসাব গুনতে শুরু করেছে। যে উচ্চপ্রযুক্তি ও কারিগরি দক্ষতার কল্যাণে জাপানে তৈরি মোটরগাড়ি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও কম্পিউটারের মতো সামগ্রীর কাটতি বিশ্বজুড়ে, জাপানের দক্ষ সেসব খাত হঠাৎ করেই যেন এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। টয়োটা মোটর কোম্পানিসহ জাপানের সব কটি মোটরগাড়ির উৎপাদককে দেশে তাদের বিভিন্ন কারখানায় গাড়ি সংযোজনের কাজ বেশ কয়েক দিন বন্ধ রাখতে হয়, যদিও অনেকেরই জানা আছে যে জাপানের মোটরগাড়ির শিল্প দেশের যেসব জায়গায় কেন্দ্রীভূত, তার কোনোটাই ভূমিকম্প কিংবা সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাই জাপানের মোটরগাড়ির শিল্প সেভাবে সাময়িক স্থবির হয়ে পড়ার কারণ অনেকের কাছে বোধগম্য না-ও হতে পারে। আর তাই বিষয়টি সহজভাবে বোঝানোর জন্য মোটরগাড়িসহ জাপানের অন্যান্য নেতৃস্থানীয় শিল্প খাত কীভাবে কাজ করে, তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া দরকার।
একটি গাড়ি তৈরি করার বিভিন্ন পর্যায়, অর্থাৎ নাট-বোল্ট লাগানো থেকে শুরু করে ইঞ্জিন বসানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ায় কয়েক হাজার যন্ত্রাংশের দরকার হয়। জাপানের মোটরগাড়ির উৎপাদকেরা অনেক আগে থেকেই দেশজুড়ে যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীদের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে নিয়েছে। গাড়ির বিভিন্ন ছোটখাটো যন্ত্রাংশ এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিয়মিত সংগ্রহ করা হয় এবং বিভিন্ন কোম্পানি থেকে আসা সেসব যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করে নেওয়ার পরই কেবল নতুন তৈরি করা একটি গাড়ি সচল হয়ে ওঠে। যন্ত্রাংশ সরবরাহকারীদের বড় একটি অংশ ভূমিকম্প ও সুনামি যেখানে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে, সেই তিহোকু অঞ্চলে অবস্থিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সে রকম অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জাপানের মোটরগাড়ির নির্মাতারা এখন যন্ত্রাংশের নিয়মিত সরবরাহ পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না। এতে অনেক কারখানাতেই উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে; এ অবস্থা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হয়। আর তাই মোটরগাড়ি নির্মাতাদের মুখোমুখি হওয়া এ রকম অপ্রত্যাশিত ক্ষতিও ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে ধরে নেওয়া দরকার এবং সরকারের হিসাবে সে রকমই করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নির্মাণের প্রক্রিয়ায়ও অনেক ক্ষেত্রে একই ধরনের সরবরাহব্যবস্থা কার্যকর বলে তাদের বেলায়ও উৎপাদনপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হচ্ছে।
অন্যদিকে ভূমিকম্পে কারখানার ক্ষতি হওয়ায় নেতৃস্থানীয় বৈদ্যুতিক সামগ্রী নির্মাতা সনিকে ফুকুশিমা জেলায় তাদের দুটি লিথিয়ান আয়ন ব্যাটারি তৈরির কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়। এর ঠিক পরপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ায় কেন্দ্রের ৩০ কিলোমিটার পরিধি থেকে সবাইকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলে সনির সেই দুটি কারখানা এখন বলা যায় বেশ কিছুদিনের জন্য উৎপাদন-প্রক্রিয়ার বাইরে থাকবে। এ কারণেই হাইব্রিড ও ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সরবরাহ এখন সীমিত হয়ে আসায় জাপানের মোটরগাড়ির শিল্পকে হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিত এক অনিশ্চিত অবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটায় জাপানের ৫৪টি পরমাণবিক চুল্লির মধ্যে ১০টি এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কবে নাগাদ এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার চালু হবে, কিংবা আদৌ চালু হবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ জাপানের বিদ্যুতের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি সরবরাহ করে থাকে বলে ১০টি চুল্লি হঠাৎ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হওয়ায় জাপানে এখন বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ঘাটতি পূরণ করে নিতে টোকিও ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি দিনের বিশেষ সময়ে এলাকাভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার যে ব্যবস্থা এখন রাজধানী টোকিও ও পাশের কয়েকটি জেলায় প্রবর্তন করেছে, তা শিল্প খাতের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে চলেছে। দিনে প্রায় তিন ঘণ্টা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধ থাকলেও অনেক কলকারখানাই প্রায় সারা দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে, যে প্রক্রিয়া দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে নিহত লোকজনের সার্বিকভাবে যে আর্থিক অবদান দেশের অর্থনীতিতে রাখার কথা ছিল, মৃত্যুতে তা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরোক্ষ যে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি দেশকে পড়তে হয়েছে, সেই হিসাবও একেবারে কম কিছু নয়। হতাহতের সঠিক সংখ্যা চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হওয়ার পরই কেবল এর ব্যাপ্তির বিস্তৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে উগ্র ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী রাজনীতিবিদেরা এখন উল্টোভাবে আবার পরিস্থিতির ফায়দা লুটতে ইতিমধ্যে ময়দান গরম করতে শুরু করেছেন। সেই দলে অন্তর্ভুক্ত রাজনীতিবিদদের মধ্যে শুরুতেই যার নাম করতে হয়, তিনি হলেন টোকিওর গভর্নর শিনতারো ইশিহারা। দুই দফায় গভর্নরের দায়িত্ব পালনের পর এখন তিনি আগামী নির্বাচনে আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ভূমিকম্প ও সুনামি, বলা যায়, জুতসই নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ তাঁর জন্য করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক এক ভাষণে তিনি যেমন বলেছেন, ‘ভূমিকম্প, সুনামি ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্ঘটনার সবটাই হচ্ছে ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তি। জাপানের লোকজন লোভী, অর্থলিপ্সু ও অহংকারী হয়ে ওঠায় ঈশ্বর তাদের শায়েস্তা করেছেন।’
আসন্ন গভর্নর নির্বাচনে ভোটার আকৃষ্ট করাই যে এ রকম মন্তব্যের মূল লক্ষ্য, তা সহজেই ধরে নেওয়া যায়। তবে কথা হচ্ছে, টোকিওবাসীর মধ্যে কিন্তু সে রকম যুক্তি ক্রমেই গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করেছে। একেও ভূমিকম্পের পরোক্ষ এক ক্ষতি হিসেবে দেখা যেতে পারে, যা কিনা ভবিষ্যতে জাপানের জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।
টোকিও, ৩০ মার্চ ২০১১
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.