তুষারপাতের নীরব সৌন্দর্য by কাজী জহিরুল ইসলাম


দুপুরের পর থেকে তুষারপাত শুরু হয়েছে। গরম কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। আইপডে বাংলা গান, মাহমুদুজ্জামান বাবু গাইছেন, আমি বাংলার গান গাই। আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসেছি, গুরুত্বপূর্ণ কোনো মেইল আছে কি-না চেক করা দরকার। আমার ডানদিকে, দোতলার জানালা দিয়ে যতদূর চোখ যায় বিশাল গলফ কোর্সের সবুজ মাঠ, উপরে বিলেতের অবিশ্বস্ত আকাশ।
কার্পাস তুলোর মতো শুভ্র তুষারের পালক দুলতে দুলতে নেমে আসছে গলফ কোর্সের সবুজ মাঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবুজ মাঠ ধবধবে সাদা হয়ে উঠল। হঠাত্ কলিং বেল বেজে উঠল। সবুজ কার্পেটে মোড়ানো সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলাম। সারাফ স্কুল থেকে ফিরেছে। ওর হাতে লাল কোর্তা আর টোপর পরা শুভ্র দাড়ি-গোঁফের সান্টাক্লস। সারাফের টুপি সাদা, কফি রংয়ের জ্যাকেট সাদা। বাইরের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে পাঁচ ডিগ্রি। আজ ওদের শেষ স্কুল। কাল থেকে বড়দিনের ছুটি। স্কুল থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে একটি করে বড়দিনের উপহার দেয়া হয়েছে। সারাফ পেয়েছে বুড়ো সান্টাক্লস।

দরজা বন্ধ করতে না করতেই আবারও ঘণ্টা বেজে উঠল। খুলে দেখি এক শ্বেতাঙ্গিনী। তাকে প্রশ্ন করলাম, কি ব্যাপার এই দুর্যোগের দিনে? আমি হেলেন, আপনাদের প্রতিবেশী। ১৬ নম্বর বাড়িটি আমার। আপনারা তো নতুন এসেছেন, তাই পরিচিত হতে এলাম। দরজা দিয়ে হু হু করে বরফ শীতল হাওয়া ঢুকছে ঘরে। এভাবে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমি কাজী, বলেই শ্বেতাঙ্গিনীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। হ্যান্ডশেক করার জন্য নয়, ওকে টান মেরে ঘরের ভেতর ঢোকানোর জন্য। বাড়ির ভেতর নারীকণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে মুক্তি নীরবে নিচে নেমে এলো। হেলেন আমাদের ঘরে এলেন বটে তবে ওর কুতকুতে চোখ দেখে মনে হচ্ছে আমার আচরণে খানিকটা ঘাবড়ে গেছেন। হেলেনের হ্যাটের কার্নিশে লেগে থাকা তুষারের কণা ঝরে পড়ছে ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর। ওর গায়ে ফারের কালো ওভারকোট। ঘরের ভেতরে হিটার চলছে। হিটারের তাপে ওভারকোটের গায়ে লেগে থাকা তুষারের পালক গলতে শুরু করলেও এখনও বুটিকের মতো সাদা সাদা দানা লেগে আছে।
ভদ্রমহিলা জানালেন তিনি এই বাড়িতে গত ১১ বছর ধরে থাকেন। আর কে কে আছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে কথা বলতেই আসলে এসেছি। আমরা তিনজন থাকি। আমি আর আমার দুটি বিড়াল। ওরা মাঝে মাঝেই তোমাদের গার্ডেনে এসে খেলাধুলা করতে পারে, তোমরা কিছু মাইন্ড করবে না তো? না, না, মাইন্ড করব কেন? ওরা অবশ্যই খেলাধুলা করবে। ওরা আমাদের গার্ডেনের গাছের নিচে বসে চাইলে অন্যকিছুও করতে পারে, আমরা কিচ্ছু মনে করব না। মুক্তি আমার দিকে কটমট করে তাকাল। হেলেনের দৃষ্টিতে এবার সন্দেহ। সাদা চামড়ার মহিলারা কারণে-অকারণে মানুষকে সন্দেহ করে, এটা ওদের রোগ। হেলেনের মুখে হাসি, চোখে সন্দেহের দৃষ্টি।
বিড়ালমাতা বিদায় নিলে আমরা উপরে উঠে এলাম। আমার ছেলে অগ্নি খুবই উত্তেজিত। গত ক’দিন ধরেই ও শুধু ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখছিল। জানত যে আজ তুষারপাত হবে। সাড়ে তিনটায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। এখন ছয়টা বাজে। লন্ডন শহরে গভীর রাত। তুষারপাত এখনও চলছে। তুষারের সৌন্দর্যটাকে আরও বেশি করে উপলব্ধির গভীরে তুলে আনতে আমরা ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দিলাম।
আরে কি আশ্চর্য তখন এক অপার্থিব নীলাভ আলো একটা লাফ দিয়ে আমাদের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। বাইরে তাকিয়ে দেখি যতদূর চোখ যায় ধু ধু সাদা বরফের মাঠ থেকে এক অলৌকিক আলোর আভা উঠছে। আমরা দিনের আলোর মতোই সব পরিষ্কার দেখতে পাই। শুধু পার্থক্যটা হলো, তুষারের মাঠ থেকে উঠে আসা এই আলোটা এক মায়াবী স্নিগ্ধতায় মাখা। এর কোনো তেজ নেই, উত্তাপ নেই, আছে কেবল স্নিগ্ধতা আর কোমল শুভ্রতায় মোড়ানো এক অপার্থিব ভালোবাসার হাতছানি। ঘরের ভেতরে, সোফার ওপর পড়ে থাকা সারাফের বুড়ো সান্টাক্লসের শুভ্র দাড়িগুচ্ছও একই স্নিগ্ধতার আভায় উজ্জ্বল। আমার কেবলই মনে হচ্ছে কোনো এক অলৌকিক উপায়ে বুড়ো সান্টাক্লসের দাড়িগুচ্ছ বড় হতে হতে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো গলফ কোর্সে।
আমি নিচে নেমে আসি। ড্রইংরুমের কাচের স্লাইডিং দরজা সরিয়ে নেমে যাই বাগানে। বাগান পেরিয়ে গলফ কোর্সে। তুষারের ঘোর আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমি এগিয়ে যাই আরও সামনে। পত্রহীন বিশাল ন্যাড়া গাছটার নিচে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখি। কান পেতে শোনার চেষ্টা করি তুষারপাতের শব্দ, কে যেন ক্রমাগত অতি নীরবে শিস দিয়ে চলেছে। যখন চোখ খুলি, দেখি আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। আমি এগিয়ে যাই। কালো ওভারকোটের হুডির আড়ালে লুকোনো মুখ। কে আপনি? সে হাত তুলে ঠোঁটে আঙুল চাপা দেয়। চুপ, তুষারের গান শুনছি। ওমা, এ-যে সেই বিড়ালমাতা, আমাদের প্রতিবেশিনী হেলেন।

No comments

Powered by Blogger.