আমাদের কাইয়ুম স্যার by আবুল মনসুর

শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের চিত্রকলার ভুবনে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। খ্যাতিমান এই শিল্পীর ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে আরেক শিল্পী ও চিত্র সমালোচকের স্মৃতিচারণায় আমাদের এবারের মূল রচনা ছোটবেলায় ছবির প্রতি প্রথম আকর্ষণটি সম্ভবত তৈরি হয়েছিল দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রতি দুর্গাপূজায় প্রকাশিত ঢাউস সাইজের পূজাবার্ষিকী দিয়ে।


শক্ত বাঁধাইয়ের এ বইগুলোর প্রতিটির আলাদা নামকরণ হতো। নবারুণ, উদয়ন—এ রকম সব নাম। এতে গল্প-কবিতা-নাটক-ভ্রমণকথা-রম্যরচনা ছাড়াও নানা মজাদার বিষয়ে লিখতেন তখনকার বড় বড় লেখক। লেখাগুলোতে অলংকরণ করতেন প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, নারায়ণ দেবনাথ, শ্রীশৈল, চারু রায়, সমর দে-সহ অনেকে। মাঝেমধ্যে আর্ট প্লেটে ব্লকে ছাপা কিছু রঙিন ছবি ছাড়া বাকি সবই সাদা-কালোয় আঁকা। আমাকে রঙিন ছবির চেয়ে বেশি আকর্ষণ করত সাদা-কালো ছবি আর প্রচণ্ড মুগ্ধ হতাম প্রতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা দেখে। অবাক হয়ে খেয়াল করতাম, সামান্য চায়নিজ ইঙ্ক আর নিবের কলমে রেখার কারিকুরি দিয়ে কী অসাধারণ দক্ষতায় তিনি আঁকতেন পাহাড়, ঝরনা, গাছ, জীবজন্তু, নানা ভঙ্গিমায় মানুষ—একেবারে বাস্তবের মতো। শিল্পী হলে প্রতুলের মতো শিল্পী হতে হবে, এমনটিই ভাবতাম।
আরেকটু বড় হয়ে একেবারে মজে গেলাম সত্যজিৎ রায়ের প্রচ্ছদ আর অলংকরণে। সত্যজিৎ তো আসলে গোটা ভারতবর্ষেরই গ্রন্থচিত্রণ ও প্রচ্ছদে এনেছেন আধুনিকতার ছোঁয়া। সঙ্গে খালেদ চৌধুরী ও কিছু পরে পূর্ণেন্দু পত্রী। এই প্রথম ধারণা জন্মাল যে শুধু বাস্তবের মতো আঁকতে পারাটাই ব্যাপার নয়, সৃজনশীল অলংকরণ বা প্রচ্ছদ কেমনটি হতে পারে। লিপিও যে একটি শিল্প এবং শুধু তাই দিয়ে কীভাবে অসাধারণ প্রচ্ছদ হতে পারে সেটিও বোঝা হলো।
তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের বইপত্রে কাজী আবুল কাশেমের কাজ দেখতাম, অনেকটাই প্রতুলের মতো হলেও ততটা দক্ষতা নেই, বুঝতে পারতাম। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ত জয়নুল আবেদিন বা কামরুল হাসানের সুন্দর প্রচ্ছদ বা অলংকরণ। তবে তা সংখ্যায় ছিল সামান্য। এরই মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে প্রকাশনাশিল্প। দৃষ্টিশোভন প্রচ্ছদগুলোতে উঠে আসতে লাগল একটি নাম—কাইয়ুম চৌধুরী। সত্যজিতের প্রভাব খানিকটা বোঝা যায়, তবে অনেকটাই নিজের মতো। ষাটের দশকে চট্টগ্রামের বইঘর হয়ে উঠল পূর্ব পাকিস্তানের সেরা প্রকাশনা সংস্থা। এখান থেকে বের হতে লাগল চোখ জুড়ানো সব বই, ছাপা-বাঁধাই আর প্রচ্ছদে যে-কারও সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মতো। চমৎকার সব প্রচ্ছদের শিল্পী মূলত কাইয়ুম চৌধুরী। ছোটদের বইয়ে তাঁর অলংকরণও একেবারে ভিন্ন রকম। কালাম মাহমুদের প্রচ্ছদও আকর্ষণীয়। বিশেষ করে, ছোটদের বইয়ের অলংকরণে সৌকর্য নিয়ে এলেন হাশেম খান, প্রাণেশ মণ্ডল ও রফিকুন নবী। মূলত সত্যজিৎ রায়ের কাজের প্রভাব-বলয়ে সূচিত হলেও অচিরেই বাংলাদেশের গ্রন্থচিত্রণশিল্প একটি নিজস্ব অবয়ব লাভ করেছে এবং এর প্রধান কারিগর অবশ্যই কাইয়ুম চৌধুরী। শিল্পশিক্ষার জগতে প্রবেশ করার আগে তাই যে কজন শিল্পী আমার আকর্ষণের পাত্র ছিলেন, কাইয়ুম চৌধুরী তাঁদের অন্যতম।
১৯৬৬ সালে তৎকালীন আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে দেখি, কাইয়ুম চৌধুরী ওখানে বাণিজ্যিক কলার শিক্ষক। বাণিজ্যিক কলার প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ সত্ত্বেও সবার পরামর্শে তৃতীয় বর্ষে উঠে চিত্রকলাতেই নাম লেখালাম। ফলে কাইয়ুম স্যারকে সরাসরি শিক্ষক হিসেবে পাওয়া হয়নি। তিনি বরাবরই স্বল্পভাষী ছিলেন, ছাত্রদের সঙ্গে অতটা খোলামেলা ছিলেন না। আমারও শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়াটা ধাতে ছিল না। ফলে ছাত্র অবস্থায় তাঁকে মোটামুটি দূর থেকেই জেনেছি। তবে বইপত্রে তাঁর প্রচ্ছদ আর অলংকরণ দেখতাম মুগ্ধ হয়ে আর তাঁর সুভদ্র ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিল একধরনের সম্ভ্রম জাগানো আকর্ষণ। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে তখন যেমনটি ছিলেন—মেদহীন ঋজু দীর্ঘকায় শরীর, দোলদোলানো লম্বা চুল; আজও আশ্চর্যজনকভাবে কাইয়ুম স্যার তেমনটিই আছেন। শরীরে যেমন মনেও তেমন—ভদ্র, পরিমিত, শীলিত। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে লক্ষ করি, তখন ছিলেন সংস্কৃতিজগতের স্বল্প পরিসরে আমাদের কজনের শ্রদ্ধার পাত্র, আজ স্যার হয়ে উঠেছেন সমগ্র জাতির বিপুল শ্রদ্ধাভাজন স্বল্প কয়েকজনের একজন।
কীভাবে তিনি অর্জন করেন এ স্থানটি? আমার ধারণা, অসাধারণ পরিমিতিবোধ দিয়ে। নিজের অবস্থানকে উচ্চকিত না করেও তিনি সবখানে আছেন, প্রতিটি আন্দোলনে, সমাবেশে। বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের যে যাত্রাপথ, তার সবকিছুর সঙ্গে তিনি থেকেছেন, এখনো সবচেয়ে অগ্রবর্তীদের তিনি একজন। সামনে আসতে চাননি মোটেই, অন্যদের পীড়াপীড়িতে এসেছেন সসংকোচে, তবে প্রয়োজনে ঝান্ডাটি ঠিকই তুলে নিয়েছেন। এভাবে কাইয়ুম স্যার একজন চিত্রশিল্পীর সীমার মধ্যে আর নেই। তিনি হয়ে উঠেছেন আমাদের মুক্তচিন্তা, প্রগতি ও সংস্কৃতির সংগ্রামে একটি প্রতীকচিহ্ন।
তাঁর সঙ্গে আমার কাছাকাছি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে অনেক পরে, আমি চট্টগ্রামে স্থায়ী হওয়ারও বেশ পরবর্তীকালে। নানাভাবে স্যারের বেশ কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ ঘটেছে সাম্প্রতিক কালে। যেটি অবাক হয়ে দেখি, সেটি, এই বয়সেও তাঁর সকল কাজে পারিপাট্য। প্রতিটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন হয় দায়িত্ব পালনে, নয় দর্শক বা শ্রোতা হিসেবে; সজীব, প্রাণবন্ত, সময়মতো। প্রচুর বাণিজ্যিক কাজ করতে হয় এখনো তাঁকে। প্রথম আলো, কালি ও কলম-এর সার্বিক দায়িত্ব তো আছেই; এর বাইরেও প্রচ্ছদ-অলংকরণের কাজের ভার এখনো আগের মতোই রয়েছে। তার মধ্যে অনেক আবার নিকট ও ভক্তজনের আবদার রক্ষার কাজ। প্রতিটি কাজ করেন পরিপূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দিয়ে, কাজের মান ও নিজের শৈলী শতভাগ বজায় রেখে। শুধু তা-ই নয়, সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন প্রকাশনার জন্য জলরঙে করা প্রতিকৃতিগুলোতে কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর সেরা কিছু শিল্পকৃতির নমুনা রাখছেন, এটি নিশ্চিত বলা যায়। এ ধরনের কাজে এই বয়সেও স্যার পরিমাণে ও শিল্পগুণে শ্রেষ্ঠত্বের আসনটি বজায় রেখেছেন, এটি বিস্ময়কর বটে। এর বাইরেও তাঁকে দেখি, সাংসারিক ও পারিবারিক জীবনেও যেমন দায়িত্ববান, স্বামী ও পিতা তেমনই উদার ও আধুনিক মননের মানুষ হিসেবে।
কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের বাণিজ্যকলার ক্ষেত্রে কিংবদন্তিসম নাম। সঙ্গে এটিও মনে রাখা দরকার যে এ দেশের চিত্রশিল্পের জগতেও দীর্ঘকাল যাবৎ তিনি প্রথম সারিতেই রয়েছেন। ঢাকার আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে পঞ্চাশের দশকে বের হয়ে যাঁরা এ দেশে আধুনিক চিত্রশিল্পের যাত্রাপথ রচনা করেছিলেন, কাইয়ুম স্যার তাঁদেরও একজন। শুধু তা-ই নয়, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সমসাময়িকদের মধ্যে বিমূর্ততার প্রবল জোয়ারের সময়কালে যে দু-একজন শিল্পী ভিন্নতর পথে প্রেরণার পথ খুঁজছিলেন, তিনি তাঁদেরও অন্যতম। জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের পর বাংলার লোককলাকে উপজীব্য করে সমকালীন শিল্পের অবয়ব নির্মাণে অগ্রসর হয়েছিলেন যে দুজন শিল্পী, তাঁদের একজন রশিদ চৌধুরী, অন্যজনের নাম কাইয়ুম চৌধুরী। রশিদ চৌধুরী যেখানে তাঁর রসদ সংগ্রহ করেছেন পূর্ব ভারতের প্রতিমাশিল্পের বিন্যাসরীতি থেকে, কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকর্মে একটু জ্যামিতিকায়িত হয়ে বিন্যস্ত হয়েছে আমাদের নকশিকাঁথা, আলপনা, পিঠা, নৌকার গলুইয়ে আঁকা চিত্রের মোটিফ। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর এই বিশিষ্টতাটিও স্মরণে রাখা প্রয়োজন।
কাইয়ুম চৌধুরীর ক্যানভাসে আর বাণিজ্যিক কলায় বাংলাদেশের গ্রামীণ নারী, কৃষক-জেলে-রাখাল, নদী-নৌকা, মাছ-পাখি, গাছ-পাতা একেকটি নিজস্ব প্রতীকচিহ্নে পরিণত হয়েছে। এটি ঘটেছে, কারণ দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর ধরে কাইয়ুম চৌধুরীর হাতে বিধৃত ও বিবর্তিত হতে হতে এগুলো সেই বিশেষ মাত্রাটি অর্জন করেছে, যেখানে এরা যতটা কাইয়ুম চৌধুরীকে মনে করায় ততটাই বাংলাদেশকেও চেনায়। এরা দিনে দিনে হয়ে উঠেছে একেকটি অক্ষরের মতো শক্তিমান রূপ। আজকে তাঁর নির্মিত ওই সব রূপকেই বাংলাদেশের বিলীয়মান পল্লিজীবন আমাদের অনেকের কাছে প্রতীয়মান রয়েছে। বাংলাদেশের দৃশ্যকলার পরিমণ্ডলে তাঁর নির্মিত জগৎ নির্মাণ করেছে বাস্তবের সমান্তরাল আরেকটি রূপ, যেটি অর্জন করেছে চিরায়তের চিহ্ন। এভাবে কাইয়ুম চৌধুরী ছাপিয়ে গেছেন সমকালের সীমা, চিত্রশিল্পীর সীমা, আর হয়ে উঠেছেন বাঙালি জীবনের এক সর্বকালীন সাথি। তাঁর সাহচর্য সব সময়ই মধুর ও আনন্দদায়ক। ৮০ বছরের প্রাণবান মানুষটিকে অযুত অভিনন্দন।

No comments

Powered by Blogger.