ইতিহাসের বাঁক বদল by মেহেদি রাসেল

এ শর্ট হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব—স্যার যদুনাথ সরকার। অনুবাদ: খসরু চৌধুরী, প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ। প্রকাশক: ঐতিহ্য, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১২। মূল্য: পাঁচশত বিশ টাকা। ইতিহাসের নানা ঘটনা পরম্পরায় বদলে যেতে থাকে একটি ভূখণ্ড এবং জাতির জীবন, ভবিষ্যৎ ও সংস্কৃতি। শাসকশ্রেণীর পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে সমগ্র জাতিসত্তায়।


ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই সত্যগুলো আরও প্রকট। বিরাট ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের লোভে এই অঞ্চল বহুকাল আগে থেকেই বিদেশি শক্তির মনোযোগের একটি কেন্দ্র ছিল। তা ছাড়া আয়তনে বড় হওয়ায় এটি আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন দিক থেকে।
ভিনদেশি আক্রমণ এই অঞ্চলের নিয়তির মতো। সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে এখানকার মানুষের সাধারণ জীবনযাপন ছিল অনেকটা আয়েশি ধরনের। ফলে যুদ্ধবিগ্রহে ভারতবর্ষের মানুষ খুব একটা সচেতন বা আগ্রহী ছিল না। জনগণের ভাবনা ছিল এমন, দেশকে রক্ষা করা বা শত্রুকে মোকাবিলার কাজটা শাসকদের। ফলে সামান্য পরিশ্রমেই এ দেশ বারবার দখল করে নিয়েছে ভিনদেশি যুদ্ধবাজেরা।
শাসকগোষ্ঠীর অদূরদর্শিতা, জনগণের সঙ্গে একধরনের বিচ্ছিন্নতা, প্রচণ্ড ভোগবিলাস প্রভৃতি কারণে তাদের দ্বারা সব সময় নিজস্ব সাম্রাজ্য রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
আওরঙ্গজেবের শাসনামলেই মোগল সাম্রাজ্য সর্বাধিক বিস্তৃতি লাভ করে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলের দখল নেওয়ার আগপর্যন্ত এটি ছিল সর্ববৃহৎ একক ভারতীয় রাষ্ট্র। তাঁর শাসনামলই ভারতবর্ষে ইসলামের অগ্রযাত্রার সর্বশেষ কাল। এই অতিসমৃদ্ধ সাম্রাজ্য থেকেই আবার পতন আরম্ভ হয় মোগল আধিপত্যের। ১৬৫৮ থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দীব্যাপী আওরঙ্গজেবের শাসন অন্য মোগল শাসকদের চেয়ে তাঁকে আলাদা ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করে। সাহস, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ইত্যাদি গুণের কারণে তিনি পূর্ববর্তীদের চেয়ে বেশি অঞ্চলজুড়ে তাঁর আধিপত্য কায়েম করতে সমর্থ হন।
আওরঙ্গজেবের পুরো জীবন নিয়ে স্যার যদুনাথ সরকার পাঁচ খণ্ডের একটি সুবিশাল গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর বিশাল কাজকেই আবার নিজেই সংক্ষেপিত করে এ শর্ট হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব নামে ১৯৩০ সালে এক খণ্ডে প্রকাশ করেন। ইতিহাসের অগাধ জ্ঞান এবং প্রচণ্ড আগ্রহ ও পরিশ্রমের ফলে তাঁর কাজটিই এখন পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের ওপর সারা বিশ্বে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কাজ বলে বিবেচিত। স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর পুরো কাজটি এমনভাবে সংক্ষেপিত করেছেন যে সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই এখানে স্থান পেয়েছে।
এ শর্ট হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব-এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি কালক্রম অনুসারে লিখিত। আওরঙ্গজেবের জন্ম, তাঁর বেড়ে ওঠা, তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা, রাজপরিবারে ক্ষমতার বিন্যাস, ক্ষমতাকাঠামোর নিয়তি নির্ধারণে বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে প্রথমেই। রাজপরিবারের অভ্যন্তরে অন্য ভাইদের চক্রান্ত, পিতা শাহজাহানের অনুগ্রহ ও বিরাগ অর্থাৎ আওরঙ্গজেবের ক্ষমতা গ্রহণে এবং তাঁর আধিপত্য বিস্তারে প্রভাবশালী ঘটনার পরম্পরা এখানে একেবারেই ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১৪ বছর বয়সে বালক আওরঙ্গজেবের হাতির সঙ্গে লড়াই এবং দুই বছর পরই গুরুত্বপূর্ণ ‘বুলেন্দা’ যুদ্ধে সেনাপতির দায়িত্বপালন সুস্পষ্টভাবে তাঁর ভবিষ্যৎ পরাক্রমকে নির্দিষ্ট করে তুলেছিল।
মোগল সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তার এবং পতন—এই দুটি ব্যাপারই আওরঙ্গজেবের শাসনামলেই সংঘটিত হয়। এর ফলে ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রধানতম বাঁক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এটি। আর এ কারণেই নিরপেক্ষ ইতিহাসবেত্তার দৃষ্টিতে দেখা এই বইটি ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ পাঠ নেওয়ার জন্য জরুরি।
ভারতবর্ষের ইতিহাস একক কোনো জাতির ইতিহাস নয়। হাজারো ভাষা সংস্কৃতির হাজারো জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস এটি। একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা থাকলেও দেখা যেত প্রায়ই নানা অঞ্চল থেকে বিদ্রোহ দানা বাঁধতে। এসব ঘটনা, সেই সঙ্গে বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা করতে করতেই একজন শাসকের পুরো জীবন অতিবাহিত হতো।
ইতিহাসের আগ্রহী পাঠকের জন্য বইটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন খ্যাতনামা অনুবাদক খসরু চৌধুরী। সাবলীল বাকভঙ্গি আর সহজবোধ্য ভাষার ব্যবহার এ বইটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

No comments

Powered by Blogger.