আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৬৫)-তারুণ্যপ্রসূত বিপ্লবী চেতনা by আলী যাকের

পথিমধ্যে আরো একটি উটকো ঝামেলা হয়েছিল। আমার দুলাভাই ও আপাকে গ্রামের দু-একজন অতিউৎসাহী লোক ঘিরে ধরল এই কথা বলে যে ওরা হিন্দু এবং ভারতে পালাচ্ছে। এ ব্যাপারে তারা নিঃসন্দেহ হলো এই কারণে যে আমার দুলাভাইয়ের গলায় ছিল কাঠের একটি তজবিহ, যেটি দেখতে অনেকটা সনাতন হিন্দুদের ব্যবহৃত হারের মতোই।


আমরা একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। পেছনে হৈচৈ শুনে আমি দৌড়ে এলাম। এসে দেখি, আমার বোনাই ততক্ষণে সেখানে পেঁৗছে গেছে আর আমার দুলাভাই ওই লোকগুলোর হুকুমে লুঙ্গি খুলতে উদ্যত। আমি দুলাভাইকে মানা করলাম এবং ওই লোকগুলোকে ধমক দিলাম, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হলো না। এই সময় আমার বোনাই একটি বুদ্ধিমানের মতো কাজ করল। ওই দুর্বৃত্তদের নেতাকে সে বলল ফজরের নামাজের আজান দিতে। তাহলে বোঝা যাবে তারা কত বড় মুসলমান। এই কথায় তারা একটু থতমত খেয়ে আমাদের ছেড়ে দিল। আমরা গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম। পরে আমি হাসতে হাসতে আমার বোনাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এত কিছু থাকতে কেন ফজরের আজানের কথা তার মনে এলো। সে হেসে বলল, 'ফজরের আজানে একটি অতিরিক্ত বাক্য আছে, সেটা তো জান?' আমি বললাম 'হ্যাঁ, আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।' সে বলল, 'আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ওরা কোনোমতে নিয়মিত আজান জানলেও ফজরের এই বিশেষ আজানটি জানবে না। আমি সেই ঝুঁকিটি নিয়েছিলাম।' আমরা দুজনেই সশব্দে হেসে উঠলাম।
রাতটি আমাদের বেজোড়ার দুলাভাইয়ের ওখানে কাটিয়ে পরদিন প্রায় শেষ রাতে ওরা আমাদের নিয়ে গেল শালদা নদীর পাড়ে। সেখানে একটি ছোট নৌকা বাঁধা ছিল। ওপরে বেশ বড়সড় ছই। ওরা বলল, এই ছইটি গতরাতে লাগানো হয়েছে যেন সবাই মিলে আমরা এর ভেতরে লুকিয়ে বসতে পারি। কেননা ততদিনে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের ওপর দিয়ে ইনস্পেকশন ট্রেনে করে পাকিস্তানি আর্মি যাতায়াত শুরু করেছে এবং যাকে-তাকে গুলি করে মারছে। আমরা নৌকার ছইয়ের ভেতরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মাঝি দাঁড় বেয়ে চলে ছপছপ শব্দে। শালদা নদীর ব্রিজ পেরুনোর পর সামান্য দূরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, কিন্তু ব্রিজ পার হওয়ার পরেই নিজেদের উল্লাস আর ধরে রাখতে পারলাম না। মৃত্যুভয় ততক্ষণে কেটে গেছে। আমরা সবাই চিৎকার করে উঠলাম 'জয় বাংলা'।
মাঝিও হেসে আমাদের স্লোগানে যোগ দিল। অল্পক্ষণের মধ্যে নদীর ধারে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হলো। এখান থেকে আমরা পায়ে হেঁটে যাব ত্রিপুরার বঙ্নগর থানায়। সেখান থেকে শরণার্থীদের সোনাইমুড়ি নিয়ে যাওয়া হয় ভাঙা একটি জিপ দিয়ে। তারপর সোনাইমুড়ি থেকে বাস অথবা ট্যাঙ্।ি পাড়ে নেমেই আমার ভেতর থেকে পুঞ্জীভূত কান্না বাঁধভাঙা বন্যার মতো উঠে এলো। আমি মুঠো ভরে বাংলাদেশের মাটি নিয়ে কাঁদতে লাগলাম প্রায় শিশুর মতোই হাউহাউ করে। আমার ভালোবাসার দেশ ছেড়ে আমি কেন বিদেশে আশ্রয় নিতে যাচ্ছি? আমার স্পষ্ট মনে আছে যে হাতের কাছে আর কাউকে না পেয়ে আমি দোষারোপ করলাম আমার দুলাভাইকে এবং ওই প্রজন্মের মানুষদের, যাদের ভোটে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। আমার দুলাভাই থতমত খেয়ে গেলেন; কিন্তু আমাকে কিছু বললেন না। স্নেহভরা চোখে পিঠে হাত রাখলেন। আমি শান্ত হলাম। পরে ভেবে দেখেছি যে তিনি এবং আজকের বাঙালি জনসাধারণের তো কোনো দোষ নেই। তাঁরাই তো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং আমার চেয়ে অনেক বেশি নির্যাতিত হয়েছেন বাংলাদেেেশর গণমানুষ ও তাদের দ্বারা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা। তাঁদেরই একজন আমার দুলাভাই। আসলে মানুষ যখন মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায় তখন সব যুক্তি-বুদ্ধির ঊধর্ে্ব চলে যায় সে। সে কারণেই সব বিষয়েই আমার তখনকার তারুণ্য এবং তারুণ্যপ্রসূত বিপ্লবী চেতনা আমাকে সব যুক্তি অতিক্রম করে, বিচার-বুদ্ধি না করে, সম্ভাব্য মৃত্যুকে পরোয়া না করেও এমন সব বিপজ্জনক কাজ করতে অনুপ্রাণিত করে। আমার আজকের বয়স যদি তখন হতো, তাহলে হয়তো অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতাম। কেননা একটি পাকিস্তানি কম্পানির অমন একটি নিরাপদ চাকরিতে আমার কোনো বিপদ হয়তো হতো না ঢাকায় থেকে গেলেও। কিন্তু তারুণ্যই তখন আমার বিদ্রোহী চেতনাকে শানিত করেছে। দেশ যে আমার মা! তার অপমান, তার অসম্মান, তার মানুষের প্রতি নিগ্রহ আমি মেনে নিতে পারিনি। আমাদের ভাষার প্রতি ওদের ঘৃণা আমাকে উন্মাদ করে তোলে। আমি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে অজানার উদ্দেশে পা বাড়াই।
এখানে আমার একটি নিজস্ব উপলব্ধির কথা আমি বলি। হয়তো অপ্রাসঙ্গিক ঠেকতে পারে। কিন্তু তবুও বলতে আমায় হবেই। আমি প্রায়ই আমার আজকের তরুণ বন্ধুদের বলি, তোমাদের বয়স আছে, এখনো তোমরা বৃহত্তর কিংবা মহত্তর কাজে তোমাদের নিরাপত্তাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পার। রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কথা বলি, 'ওরে সাবধানী পথিক, বারেক পথ ভোল; পথ ভোল; পথ ভুলে মর ফিরে...' অথবা হেলাল হাফিজের লেখা সেই অমোঘ কবিতার লাইন, 'এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়', এগুলোর অমোঘ ইঙ্গিত সেই দিকেই যে তারুণ্যের সঙ্গে সাবধানতা পরস্পরবিরোধী। আর অতি সাবধান হলে জীবনে বৃহৎ কিংবা মহৎ কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.