খসড়া ছাড়াই বৈঠক শেষঃ তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি অনিশ্চিত


শেষ পর্যন্ত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠকে আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যু অনিশ্চয়তার আবর্তে পড়েছে। পানি বণ্টন চুক্তির খসড়া তৈরি ছাড়াই শেষ হয়েছে কমিশনের সচিব পর্যায়ের বৈঠক। অথচ কথা ছিল, এ বৈঠকে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি হবে এবং কারিগরি পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময় দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকে এটি উপস্থাপন করা হবে।
কিন্তু সে পর্যায়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তারা। শুধু চুক্তি হওয়ার প্রক্রিয়ার সম্ভাবনার মধ্য দিয়েই ফলশূন্য অবস্থায় শেষ হয়েছে বহু প্রত্যাশিত এ বৈঠক। ফলে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনাও অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলা যায়। এদিকে ভারতীয় প্রতিপক্ষ ইছামতি নদী খনন ও বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে ত্রিপুরায় পানি নেয়ার প্রস্তাব ঐকমত্যের ভিত্তিতে আদায় করে নিয়েছে। বস্তুত ভারতের এই দুই প্রস্তাবের ফলেই শেষ পর্যন্ত গৌণ হয়ে পড়েছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন আশা-নিরাশার দোলাচলে।

জেআরসি বৈঠকের যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে তিস্তা ইস্যুর ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও আপাতত ভারত তাদের লাভালাভের হিসাব যে কাজে লাগাতে পেরেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের ন্যায্য প্রাপ্তির বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে তাদের প্রস্তাব পূরণে ঐকমত্যে যেতে তাদের তেমন বেগ পেতে হয়নি। জানা গেছে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ইছামতি নদী পুনঃখননের কাজ শুরু করতে রাজি হয়েছে দুই দেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশের ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে নেয়ার প্রকল্প শুরু করতেও সম্মত হয়েছেন দুই দেশের কর্মকর্তারা। অথচ তিস্তার পানির বিষয়টি আটকে গেছে পূর্বাপরের মতো আলোচনার গ্যাঁড়াকলে।
উল্লেখ্য, যৌথ নদী কমিশনের এ বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির খসড়া তৈরিসহ অভিন্ন ৫৪ নদীর পানি বণ্টন ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে একটি প্যাকেজ প্রস্তাব তৈরি করা এবং প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে তা উপস্থাপন করা। এ উদ্দেশ্যেই গত ৪ জানুয়ারি ঢাকায় নদী কমিশনের বৈঠক শুরু হয়। কার্যত ভারতীয় প্রতিপক্ষ তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিকে সামনেই আনেনি। চুক্তির খসড়া তৈরির প্রস্তাবে কোনো অবস্থাতেই রাজি করানো যায়নি তাদের। অবশেষে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো’—এমন অবস্থার শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল প্রতিপক্ষকে তিস্তার পানির প্রয়োজন সম্পর্কে নাকি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই বোঝাতে পারাটাকেই আপাতত সাফল্য বলে মনে করছেন। ভাবটা এরকম যে, তিস্তা নদীর উজানে গজলডোবা নামক স্থানে বাঁধ দিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের ফলে তার কী বিরূপ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে তা যেন জানে না ভারতীয় কর্তৃপক্ষ! অথচ তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের সঙ্গে দেনদরবার করে আসছে। এই দেনদরবারের রেকর্ডপত্র সম্পর্কে ভারতীয় প্রতিনিধি দল অবহিত নয়—এ কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না।
সব মিলিয়ে ভারত তাদের দাবি-দাওয়ার পথ পরিষ্কার করলেও বাংলাদেশ আপাতত পিছিয়ে পড়েছে। ভারতের পানিসম্পদ সচিবের ভাষ্য থেকেও তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে বাংলাদেশের প্রাপ্য পানির পরিমাণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, কোন দেশ কত ভাগ পানি পাবে, সেটা ঠিক করার দায়িত্ব আমাদের দেয়া হয়নি। এটি উচ্চ পর্যায়ে নির্ধারিত হবে। আপাতত এই আশ্বাস বাণীর ওপর ভরসা করেই এগুতে হবে বাংলাদেশকে। ভারত স্বেচ্ছায় আমাদের ন্যায্য দাবি পূরণ করবে না, কাজেই যৌক্তিক চাপ সৃষ্টি করে তা আদায় করার পথ অবলম্বন করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। চুক্তির খসড়া ছাড়াই সচিব পর্যায়ের বৈঠকের সমাপ্তি তারই পূর্বাভাস বহন করছে। বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পানি সচিব প্রকারান্তরে তাই বলেছেন। তার ভাষ্য মতে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে তিস্তা চুক্তি হবে কি-না। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের পূর্বাপর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বাংলাদেশ ভালো করেই অবহিত। এ ব্যাপারে ভারত বরাবরই একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, অন্যদিকে পানি শূন্যতার তাবত্ সঙ্কট দীর্ঘকাল ধরে মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। কাজেই সিদ্ধান্ত এখন নিতে হবে বাংলাদেশকেই।

No comments

Powered by Blogger.