প্রযুক্তির ৫ উদ্ভাবন

তরুণদের তৈরি অনেক প্রযুক্তি প্রকল্প মাঝেমাঝেই চমকে দেয় আমাদের। সম্প্রতি শেষহওয়া বেসিসের সফটওয়্যার মেলাতেও দেখা গেল এমন কিছু প্রকল্প।যেগুলো ছিল ‘আবিষ্কারের খোঁজে ২০১২’ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত বাছাই।


সেগুলোর পাঁচ প্রকল্প নিয়ে লিখেছেন ইমাম হাসানত অ্যানিমেশন তৈরির সহজ কাণ্ডারি
হাসিনুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন, সাফায়াতুল ইসলাম ও শুভ্র সরকার—এই চার তরুণের হাতেই উদ্ভাবন প্রযুক্তিটার। চারজনই কাজ করছেন একটি অ্যানিমেশন তৈরির প্রতিষ্ঠানে।নিজেদের কাজে নিত্যদিন যেসব সমস্যা চোখে পড়ে, তা নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা। সেই সঙ্গে এ দেশের অ্যানিমেশন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কী কী করার আছে, তা নিয়েও চলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা। শুধু আলোচনা থেকে বাইরে এসে কিছু করার আগ্রহ জন্মে চারজনেরই। তার পর থেকেই কাজ শুরু করেন তাঁরা। শুরুতে নিজেদের কাজের সুবিধার কথা ভেবেই ধারণাটা নিয়ে বসেন। চার তরুণের কাছেই জানা গেল, বিদেশি সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করে অ্যানিমেশন ছবি বানাতে লাখ লাখ টাকা দরকার। তা ছাড়া সময় লাগে প্রায় বছর খানেক। যে কারণে বাংলাদেশে অ্যানিমেশন মুভি বানাতে আগ্রহী লোক কম। শুভ্র সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশে অ্যানিমেশন জনপ্রিয় করতে চাইলে এর উন্নয়নে দরকার আধুনিক যন্ত্রপাতি, যা বিদেশ থেকে আনতে হয় বলে প্রচুর টাকা ও সময় লাগে। এসব দিক বিবেচনা করেই কাজে হাত দিই আমরা।’ কাজও এগিয়ে নেন। প্রস্তুত করেন এমন একটি সফটওয়্যার, যা কিনা আধুনিক অ্যানিমেশন তৈরিতে পারদর্শী। তাঁদের তৈরি ‘অ্যাফোর্ডেবল মার্কার লেস মোশন ক্যাপচার সলিউশন’ সরাসরি মানুষের কঙ্কাল শনাক্ত করে সম্পূর্ণ শরীর নাড়াতে সক্ষম। এ ছাড়া অ্যানিমেশন করতে আলাদা কোনো পোশাকেরও দরকার হবে না, যা অ্যানিমেশন করতে প্রচলিত সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ কম সময় নেয়। খরচও হাতের নাগালে। সফটওয়্যারটি তৈরির পর লোকজনের ফিডব্যাকের জন্যই আবিষ্কারের খোঁজে প্রতিযোগিতায় আসা। সেখানেই আসে প্রথম রানার আপের পুরস্কার।

না দেখেই বই পড়া
‘এমন যদি হতো যে না দেখেই বই পড়া যেত। তাহলে বিশেষ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য লেখাপড়া আরও সহজ হয়ে যেত। কারণ, তারা চোখে দেখতে না পারায় আর দশজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো সহজে পড়তে পারে না। এ জন্য অন্যের সাহায্য দরকার পড়ে। তাঁদের এই কষ্ট দূর করতেই বুদ্ধিটা মাথায় আসে। কাজ শুরু করি। বছর দুই আগে তৈরি করি অনলাইন গ্রন্থাগারের এই সাইটটা। এবারে অংশ নিই আবিষ্কারের খোঁজে। তারপর তো সেরা দশে চলে এলাম।’ বলছিলেন আছিয়া খালেদা। আছিয়ার ওয়েবসাইটে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার বইগুলো রাখা হয়েছে। দুটি পদ্ধতিতে বইগুলো পড়া যাবে। ব্রেইল পদ্ধতির বইগুলো নামিয়ে নেওয়া (ডাউনলোড) যাবে। তা ছাড়া আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে টকিং বুক, যা খুললেই নিজে নিজে পড়ে শোনাবে পাঠককে। অর্থাৎ পাঠক তখন হয়ে যাবেন শ্রোতা। তা ছাড়া সারা বিশ্বে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সব খোঁজখবর নিয়মিত পাওয়া যাবে এই সাইটে। এখানে ব্লগের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে। আছিয়া খালেদা বললেন, ‘এবার দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করেছি। আগামীতে অন্য প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে কাজ করার ইচ্ছা আছে।’

কোন রোগে কী দাওয়াই
কোন রোগের জন্য কোন ওষুধ খেতে হবে, তা আপনিও বলে দিতে পারেন। বাংলাদেশের কোন কোন প্রতিষ্ঠান কোন কোন ওষুধ সরবরাহ করে, এই কৌতূহল মেটাতে পারেন ঘরে বসেই। ইন্টারনেটে একটি ওয়েবসাইটে বসেই পাওয়া যাবে রোগ আর পথ্যের সব আদ্যোপান্ত। আর ওয়েবসাইটটি তৈরি করেছেন পাঁচ ফার্মাসিস্ট বন্ধু। তাঁরা হলেন সায়হাম আহমেদ বীন হালিম, নাজমুল হাসান, আজহারুল ইসলাম, মেজবাউল গাফফার ও মাহবুবুর রহমান।
যেখানে পাওয়া যাবে রোগ আর ওষুধের প্রায় সব ধরনের তথ্য। সফটওয়্যার মেলায় প্রদর্শন করা হয় এই ওয়েবসাইট। ইতিমধ্যে প্রায় ৫০০ সদস্য হয়ে গেছে সাইটটির। জনপ্রিয়তা বাড়ছে প্রতিদিনই। সাইটটি সম্পর্কে সায়হাম বলেন, ‘আমরা চেয়েছি এই সাইটটা যাতে করে সত্যি সত্যি মানুষের কাজে লাগে। আর তাই আমরা এর ব্যাপ্তি বাড়াচ্ছি প্রতিদিন। এটি একটি স্বাস্থ্যসেবার ওয়েবসাইট।’
কোন ওষুধের নাম কী, সেটি কোন নিয়মে বানানো, কোন কোম্পানির ওষুধ—এসবই জানা যাবে এখানে। মেডিকেল ক্লাসিফিকেশনের মাধ্যমে ওষুধগুলোকে ভাগ করা আছে। এ ছাড়া আপনি যে ওষুধটি খাচ্ছেন, তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কী, জানা যাবে এখানে। কোন ওষুধ খেলে কী বাদ রাখবেন, তা জানতে পারা যাবে এখানে। আর এগুলো জানতে হলে আপনাকে নিবন্ধন করতে হবে বিডিড্রাগস ডটকমে। নিবন্ধন একেবারে বিনা মূল্যে। সারা দেশে হাসপাতালের তালিকা, ঠিকানা ও ফোন নম্বর পাওয়া যাবে এখান থেকে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য দিবসে এখানে পড়তে পারেন বিশেষ কোনো রোগ ও এর আদ্যোপান্ত। পাওয়া যাবে স্বাস্থ্যবিষয়ক চাকরির খোঁজখবর। কোন ওষুধ কোন বাজারে গেলে সহজে পেতে পারেন, তার একটি তালিকা অচিরেই প্রকাশ পাচ্ছে এখানে।

কথায় চলেরোবট
এটি একটি স্মার্ট মোবাইল রোবট। চাইলে সামরিক গোয়েন্দা রোবটের কাজে একে ব্যবহার করা সম্ভব। বিপজ্জনক এবং দুর্গম এলাকায় রোবটটি কাজ করতে পারবে কোনো মানুষ ছাড়াই। মোবাইল ফোনে কথার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তাকে। একইভাবে রোবটের সঙ্গে থাকা ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে সেখানকার ছবিও দেখা সম্ভব। যেহেতু এটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তাই মোবাইলের ফোনের নেটওয়ার্ক আছে এমন যেকোনো দূরত্বে কাজ করতে পারবে রোবটটি। রোবটটিতে তথ্য প্রক্রিয়া করার জন্য এআরএম প্রসেসর এবং যোগাযোগব্যবস্থার জন্য জিএসএম, জিপিআরএস ও জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান ফিরোজ আহমেদ। কথা শণাক্ত করার (ভয়েজ ডিটেকশন) প্রযুক্তিটি চাইলে রোবট বাদে হুইল চেয়ারে সেট করা সম্ভব। তখন এটি হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীর অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই নিজের কথার মাধ্যমে এটি চালাতে পারবে। এর বাইরেও অন্য অনেক কমান্ড শিখিয়ে দিলে রোবটটি ঠিকমতো তা সম্পন্ন করতে পারবে। বাসার নানা কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে রোবটটি। ছোটবেলা থেকেই রোবটের প্রতি আলাদা আগ্রহ ফিরোজ আহমেদের। বেশ কিছু রোবট বানিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। তাঁর রোবটের খবর প্রচার করেছে বিবিসি, সিএনএন বা রয়টার্সের মতো সংবাদমাধ্যম। বিভিন্ন সময়ে রোবট বানিয়ে তা কীভাবে মানুষের নানা কাজে লাগতে পারে তা নিজে ভাবেন। তবে এবারের রোবটটি নিয়ে ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘ছোট শিশুদের দেখাশোনা করতে বাসায় এমন একটি রোবটই যথেষ্ট। এমনকি বাচ্চাটির কান্না যদি তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে শিশুটি কেঁদে উঠলেই রোবট নিজে ফোন করে তা জানিয়ে দেবে। আপনি ফোনটি রিসিভের পর কথা বলে রোবটটি চালিয়ে দেখতে পারবেন বাচ্চাটি কেমন আছে।’ এমন নানা সুবিধা দিতে পারবে রোবটটি।
আবিষ্কারের খোঁজে প্রতিযোগিতায় রোবটটি তাই জিতে নিয়েছে চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার।

আপনার হয়ে যন্ত্র বলবে কথা
নিজের মনের ভাব অন্যকে বোঝাতে কথা বা ভাষা ব্যবহার করি আমরা। কিন্তু যাঁরা কথা বলতে পারেন না, তাঁরা যেমন নিজেদের বোঝাতে পারেন না, তেমনি অনেক সময় অন্যকেও বোঝাতে পারেন না। এমনই বাকপ্রতিবন্ধী বা বয়স্ক ব্যক্তির যোগাযোগ সহজ করে দিতেই টকিং অ্যাসিস্ট্যান্ট। যে যন্ত্রটি ব্যবহার করে তাঁরা সহজেই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারেন। নিজের কাজ সহজ করতে তাঁদের একটি বাটন চাপাই যথেষ্ট। তাঁর কথাটি অন্যকে জানিয়ে দেবে যন্ত্র নিজেই। আর অভিনব এই যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেছেন বজলুর রহমান। নিজে কাজ করছেন একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাপক হিসেবে।
বজলুর রহমান বলেন, ‘যন্ত্রটিতে রয়েছে বেশ কিছু বাটন, যেখানে দৈনন্দিন কাজে দরকারি কথা ছাড়াও অন্যের সঙ্গে সাধারণ যোগাযোগের নানা কথা সংরক্ষিত আছে। ব্যবহারকারী নিজের ইচ্ছামতো বাটন চাপ দিয়ে অন্যকে তাঁর প্রয়োজনটি সহজে বোঝাতে পারবেন। কথা বলতে না পারা অসহায় মানুষের কথা ভেবেই এমন যন্ত্রের চিন্তা মাথায় আসে। অন্যের কাজে লাগলেই আমার আবিষ্কার সার্থক হবে বলে মনে করি।’ বাংলা ভাষায় তৈরি এ যন্ত্রটিতে সংরক্ষিত কথা ছাড়াও নিজের প্রয়োজনীয় কথাগুলো সংযোজন করে দেওয়া যাবে। সঙ্গে যন্ত্রটির এলসিডি ডিসপ্লেতে ডিভাইস উচ্চারিত বাক্যটি দেখা যাবে।

No comments

Powered by Blogger.