বাংলাদেশ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে by বদরুদ্দীন উমর


সমাজ ও দেশের অবস্থার পর্যালোচনা দরকার। এর জন্য একটা কালও নির্দিষ্ট করা দরকার। এ কারণে বছর পার হওয়ার পর সাধারণত এই পর্যালোচনা করা হয়ে থাকে। ২০০৯ সালের শেষে এবারও তাই হচ্ছে। বিগত এক বছরের ঘটনাবলীর ও জনগণের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ইতি ও নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে নিজ নিজ শ্রেণী, দলগত ও ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে, ব্যবসায়িক ও পেশাগত দিক থেকে পর্যালোচনা হচ্ছে।
২০০৯ সালের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে যে, এই পুরো বছরটাই নতুন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমল। প্রকৃতপক্ষে ১৯৯০ সালের পর আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সরকারের আমল। এ কারণে ২০০৯ সালের পর্যালোচনায় স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ শাসনের ওপর আলোচনা ছাড়া এ কাজ ঠিকমত হওয়ার নয়। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু আওয়ামী লীগ নিয়ে পড়ে থাকলে পর্যালোচনা যে একদেশদর্শী, অসম্পূর্ণ ও ভারসাম্যহীন হতে বাধ্য, এতে সন্দেহ নেই।

এ প্রসঙ্গে যে বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা দরকার তা হলো, প্রথম থেকেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী নৈতিক, রাজনৈতিক ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতার দিক দিয়ে ক্রমেই অবনতির দিকেই যাচ্ছে এবং একের পর এক সরকারের নীতি ও কাজকর্মের মধ্যে এর প্রতিফলন ঘটছে। এদিক দিয়ে বলা চলে যে, এরশাদের সামরিক শাসনের পরবর্তী পর্যায়ে বিএনপির প্রথম সরকারের শাসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের শাসন, তারপর বিএনপির দ্বিতীয় সরকারের শাসন, দুই বছরের বেনামি সামরিক শাসন এবং এখন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সরকারের শাসন ধাপে ধাপে অবনতির পথ ধরে অনেকদূর নেমে এসেছে। কাজেই বিগত এক বছরের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শাসনকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং খাদ্য খাতে উন্নতির বিষয়ে অনেক কথা বলা হয়। এদিক দিয়ে শাসকশ্রেণী ও তাদের সরকারের একটা ইতিবাচক দিক থাকলেও এর মধ্যে যে ফাঁক আছে সে বিষয়ের উল্লেখ থেকে তাদের প্রবক্তা ও মুখপাত্রেরা বিরত থাকেন। খাদ্য সম্পর্কে বলা চলে যে, ধান উত্পাদন বাংলাদেশে যেভাবে হয়েছে তাতে দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার মোটা খাদ্য সংস্থান একভাবে করা সম্ভব হলেও এ ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ কম নয়। সারা দেশজুড়ে কোটি কোটি মানুষ যে তিনবেলা ভরপেট আহার না করে থাকেন অথবা তাদের বাধ্য হয়ে থাকতে হয় এটা বাংলাদেশে ‘সন্তোষজনক’ খাদ্য পরিস্থিতির একটা উল্লেখযোগ্য দিক। যদি দেশের সব মানুষের তিনবেলার স্বাভাবিক খাদ্য সংস্থানের বিষয় বিবেচনা করা হয় তাহলে বাংলাদেশের ধান উত্পাদন ‘সন্তোষজনক’ হলেও প্রকৃত খাদ্য ঘাটতি অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশে এখন দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর ঘটনা নেই; কিন্তু যথেষ্ট খাদ্যের অভাবে অপুষ্টির কারণে নানা ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব আছে এবং অপুষ্টিজনিত কারণে শিশুমৃত্যু থেকে নিয়ে অন্যান্য মৃত্যুর খবর কম নয়।
কিন্তু এটাই সব নয়। খাদ্য পরিস্থিতির অন্য দিকও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যাবে যে, আগে প্রয়োজনমত তেল, চিনি, ডাল, মসলা, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি খাদ্যবস্তু মোটামুটিভাবে দেশেই উত্পাদিত হতো, আমদানি করতে হতো অল্প। এখন এসব জিনিসই বড় আকারে আমদানি করতে হয়। এমনকি কলা ও মাছ পর্যন্ত এখন আমদানির তালিকায় আছে। ধান চাষের এলাকা বৃদ্ধি করতে গিয়ে এসব ফসলের চাষ কমিয়ে আনা এই ঘাটতির অন্যতম প্রধান কারণ। কিন্তু খাদ্য ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যহীনতা এখন দেখা যায় সামগ্রিক পরিকল্পনাহীনতাই এর প্রধান কারণ। সব সরকারের ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এদিক দিয়ে কোনো ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশে নৈতিক অবনতির দিকে তাকালে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবস্থা সহজেই লক্ষণীয়। সাধারণভাবে সমাজে মিথ্যা, প্রতারণা আগের তুলনায় সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা ক্ষমতাসীন ও নানা ক্ষেত্রে প্রভাবশালী তাদের ঘুষ, কমিশনখোরীসহ নানা দুর্নীতির সঙ্গে ব্যাপক জনগণের পরিচয় আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি কাজকর্ম তো বটেই, এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি এখন প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছে। এসবের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া এখানে সম্ভব নয়। তবে এটা অবশ্যই বলা দরকার যে, বিগত বছরের হিসাব নিলে দেখা যাবে যে, এই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন না ঘটে এর অবনতিই ঘটেছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার যা করছে তার উল্টো কথা বলতে তাদের নেতৃত্বের, বিশেষ করে তাদের নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর কোনো অসুবিধে হয় না। তিনি এখন প্রায়ই বলেন, তাদের কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। একথা যখন তিনি বলেন, ঠিক তখনই তার ও তার পুত্রের বিরুদ্ধে জ্বালানি খাতে বিরাট অঙ্কের ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ নিয়ে সংবাদপত্রে তোলপাড় হচ্ছে! এতে তার কিছু যায় আসে না। কথা ও কাজের নির্বাহ ফারাক যেভাবে এরশাদের সময় থেকে শুরু হয়েছে তার ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়েনি। আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারের আমলে সেটা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
তাই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একথা বলতে অসুবিধে হয় না যে, তারা ক্রসফায়ারের বিরোধী এবং দেশে এখন কোনো ক্রসফায়ার হচ্ছে না। এটা যখন তিনি বলেন তখন সরকারের নির্দেশে সারা দেশে নির্মমভাবে পুলিশ ও র্যাবের ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড চলছে। তারা বলছেন, এগুলোর বিচার করে তারা দেখেছেন প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পুলিশ ও র্যাব আক্রান্ত হলে পাল্টা আক্রমণের কারণেই মৃত্যু হচ্ছে এবং যারা এভাবে মারা পড়ছে তারা সবাই সন্ত্রাসী। অথচ স্বভাবতই দেখা যাচ্ছে যে, এভাবে নিহত লোকদের মধ্যে কিছু সন্ত্রাসী থাকলেও বিপুল অধিকাংশই নিরীহ। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নামের ভুলের জন্য মারা পড়ছেন। তাদের দিক থেকে পুলিশকে আক্রমণ করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার, আক্রান্ত হলেও পুলিশ ও র্যাবের লোকের মৃত্যু হচ্ছে না। মৃত্যু হচ্ছে দ্রুত আক্রমণকারীর! এ বিষয়ে যে একঘেয়ে কাহিনী পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাই জনগণের কাছে নেই। কাজেই এই মিথ্যা কাহিনীর মাধ্যমে তাদের দ্বারা, অর্থাত্ সরকারের দ্বারা জনগণকে প্রতারণার চেষ্টা মাঠে মারা যাচ্ছে। বস্তুতপক্ষে বর্তমান সরকারের আমলে ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ড, জেলে আটক অবস্থায় হত্যাকাণ্ড যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এর কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। গত বছর বিডিআর বিদ্রোহের পর থেকে আটক বিডিআর জওয়ানদের মৃত্যু সংবাদ পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায়। এগুলো আটক অবস্থায় হত্যাকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এর কোনো তদন্তও নেই।
শুধু এ ধরনের হত্যাকাণ্ডই নয়, সাধারণভাবে মত প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ ও হামলা কোনো নতুন ব্যাপার না হলেও এর মাত্রা এখন সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মিটিং, মাইক ব্যবহার, মিছিল ইত্যাদির জন্য সরকারি অনুমতির ব্যবস্থা করে এবং নানাভাবে বিধিনিষেধ আরোপ ও হামলা করে এমন এক অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে যার সঙ্গে ২০০৭-২০০৮ সালের বেনামি সামরিক শাসনের বিশেষ পার্থক্য নেই। এদিক দিয়ে মনে হয় না যে, একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে এখন একটি সংসদীয় সরকার ক্ষমতায় আছে। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের মাধ্যমে শসকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য এখানে এক ফ্যাসিস্ট সরকারই ক্ষমতাসীন হয়েছে।
নিজেদের ক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষমতা এ দেশের শাসকশ্রেণীর কোনো সরকারেরই নেই। আওয়ামী লীগ এখন এ বিষয়টি খুব প্রকাশ্যেই আমলে এনেছে। কারণ হচ্ছে, এদের আমলে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অনেক উন্নতি হয়েছে। আসলে এখন যা হয়েছে এবং অধিকতরভাবে হচ্ছে তা হলো, বাংলাদেশ উত্তরোত্তরভাবে উপরের দেশগুলোর সঙ্গে অধীনতামূলক সম্পর্কের অক্টোপাসে আবদ্ধ হচ্ছে। কাজেই এক্ষেত্রে সম্পর্কের উন্নতি এবং আরও উন্নতির অর্থ হলো, অধীনতা এবং আরও অধীনতা। এদিক দিয়ে বিগত এক বছরের সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ‘অর্জন’ সামান্য নয়।
শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিলে তারা নিজেদের গঠনতন্ত্রের বরখেলাপ করে যেভাবে নির্বাচন উচ্ছেদ করে দিয়ে সভাপতি বা চেয়ারম্যানকে বিভিন্ন পদে মনোনয়নের এখতিয়ার দিয়েছে এটা গণতন্ত্রের নাম-নিশানা নিশ্চিহ্ন করারই শামিল। নিজেদের দলের মধ্যেই যারা গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠা করেছে তারা দেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্র বরাদ্দ করবে—এটা আশা করার মতো অবান্তর ব্যাপার আর কী আছে?
এ প্রসঙ্গে এটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, যে সমাজে ও দেশে গণতন্ত্রের এই অবস্থা ঘটে তাদের শাসকশ্রেণীর জন্য নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এটাই এদের পরনির্ভরশীলতা, সাম্রাজ্যবাদীদের ওপর নির্ভরশীলতার মূল কারণ। এই পরিস্থিতির তাত্পর্য এই যে, জনগণের শত্রু হিসেবে এ রকম শাসকশ্রেণী অত্যান্তিকভাবে দুর্বল।
কিন্তু বাংলাদেশের এখন এমন অবস্থা যে, এখানে শক্তিশালীভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী কোনো শক্তি সাংগঠনিকভাবে নেই। সাধারণভাবে বামপন্থী নামে যারা পরিচিত তারা দক্ষিণপন্থী শাসকশ্রেণীরই বাম অংশ ছাড়া অন্যকিছু নয়। এজন্য এরা দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে কিছু কথা বললেও তাদেরই সঙ্গে শ্রেণীগত গাঁটছড়ায় বাঁধা। এদের কারও কিছু করার ক্ষমতা না থাকার কারণে এরা ‘ঐক্য ঐক্য’ বলে সব সময়ে আওয়াজ দিতে থাকে। এর দ্বারা তারা বোঝাতে চায় যে, বামপন্থীদের ঐক্য না থাকার জন্যই তাদের পক্ষে বিশেষ কিছু করা হচ্ছে না। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, তাদের মধ্যে ঐক্য নেই এটা ঠিক নয়। তারা বিভিন্ন জোটের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের ঐক্য দিয়ে কিছুই হচ্ছে না, কারণ তারা নিজেরা কতকগুলো শূন্য ছাড়া আর কিছুই নয়। শূন্যের সংখ্যা যাই হোক, তার ঐক্য দিয়ে শূন্য ছাড়া আর কিছুই হয় না। বামপন্থীদের বর্তমান ঐক্য এদিক দিয়ে অর্থহীন এবং তাদের আরও ঐক্যের আওয়াজ এক তামাশার ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়।
কিন্তু পরিস্থিতি এই মুহূর্তে যাই হোক, এর পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। জনগণের প্রতিরোধ আমাদের দেশের এক পরিচিত ঐতিহাসিক ব্যাপার, এক অপরাজিত রাজনৈতিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য জনগণ অবশ্যই রক্ষা করবেন। কোনো ফ্যাসিস্ট ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই এর সম্ভাবনাকে দীর্ঘদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.