হে ইলিশ by ইমরান উজ-জামান

ছয় মাস ধরে জরিপকাজ চলে। ২০১১ সালে মৎস্য সপ্তাহ চলাকালে (৬-১৬ অক্টোবর) এই জরিপকাজ শেষ করা হয়। জরিপকাজে অংশ নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দেওয়ান আলী আহসান, চেয়ারম্যান, মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগ (দলনেতা) দলের অন্যরা হলেন: অধ্যাপক নিয়ামুল নাসের, নজরুল কবির, শরিফ, রোমানা ইয়াসমিন,


হাসান ফারুক, মো. মফিজুর রহমান চৌধুরী, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. সুগাতা হাজরা ও তাঁর দল সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান ফিসারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (সিআইপিআরআই) ড. উৎপল ভৌমিক, এ পি শর্মা

কথায় আছে, মাছে ভাতে বাঙালি। মাছ বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের একটা প্রধান অনুষঙ্গ। অন্যদিকে মাছ বাঙালি সংস্কৃতির অংশও। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, কিংবা পরিবারের খাবারের মেন্যুতেও ইলিশ একটা খুবই প্রয়োজনীয় খাবার। আর যদি আপনি বৈশাখের কথা বলেন, তাহলে তো ইলিশ ছাড়া চলবেই না। ইলিশকে কেন্দ্র করেই রমনার বটমূলের বৈশাখ বরণ উৎসবের সবচেয়ে বড় আয়োজন পান্তা-ইলিশের দোকান বসে। ইলিশভাজার সঙ্গে পান্তাভাত। বাংলার রসুইঘরে কত রকমের ইলিশ যে রান্না হয়। সরিষা ইলিশ, দই ইলিশ, পুদিনা ইলিশ, কচু ইলিশ, পটল ইলিশ আর ডুবা তেলে ভাজা ইলিশের পেটি তো আছেই। একসময়ের সেই ইলিশের সুদিন আর নেই। দিনে দিনে ইলিশের প্রজনন দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় আগের মতো আর ইলিশ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়া ইলিশের প্রজননক্ষেত্র স্বাভাবিক অবস্থায় কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায়। সমস্যা শনাক্তকরণ ও করণীয় নির্ধারণে বাংলাদেশ ও ভারতের গবেষকদের যৌথ উদ্যোগে মাঠপর্যায়ে এক অনুসন্ধানী জরিপকাজ চালানো হয়, গত....। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান দেওয়ান আলি আহ্সানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল এই জরিপকাজে অংশ নেয়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনভার্সন অব নেচার (আইইউসিএন) সহযোগিতা দেয় এই কাজে। সঙ্গে অংশগ্রহণ করে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল ও সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ান ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিআইএফআরআই)। বাংলাদেশের ভোলা, পটুয়াখালী, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মাওয়া এবং রাজশাহীতে এই জরিপকাজ সম্পন্ন হয়। জরিপের বিষয়, উদ্ঘাটিত সমস্যা ও এর সমাধান নিয়ে বিশদ অবহিত করেন অধ্যাপক দেওয়ান আলী আহ্সান।

কেন হ্রাস পেল ইলিশ আহরণ
ইলিশের প্রজননক্ষেত্র কমে গেছে বিভিন্ন কারণে। প্রজননক্ষেত্র কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ইলিশ আহরণে। ইলিশ মাছ এখন আর প্রজননকালে অবাধে উজানে উঠে আসতে পারে না। কারণ,
উজানের নদীগুলোর নাব্যতা অতিমাত্রায় কমে গেছে। ফারাক্কা বাঁধ ও আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবও পড়েছে পরিবেশে। একইসঙ্গে দিনে দিনে বড় নদীগুলোর পানিপ্রবাহও কমে যাচ্ছে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ইলিশের স্বাভাবিক বিচরণ। ফলে নদীর অভ্যন্তরভাগে না এসেই ইলিশ বাধ্য হচ্ছে নদীর মোহনাতেই ডিম ছাড়তে। নদীর মোহনায় ডিম পাড়াটা ইলিশের প্রজননের স্বাভাবিক নিয়মের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এর প্রভাব হিসেবে ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে দারুণভাবে, তাই আহরণ কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
আর এ অবস্থা চলতে থাকলে ইলিশ বিপন্ন মাছের তালিকায় চলে যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ইলিশের স্বাভাবিক প্রজনন অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রথমেই নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেছেন অধ্যাপক দেওয়ান আলী আহ্সানের নেতৃত্বাধীন গবেষক দল।
ইলিশ আহরণ কমে যাওয়ার আরেকটি মূল কারণ হচ্ছে অবাধে জাটকা নিধন।
ইলিশ তার প্রজননকাজ যেন সহজে করতে পারে, সে জন্য প্রজননের ভরা মৌসুমে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু লোভের বশে এবং অনেক দরিদ্র জেলে পেটের দায়ে ডিমঅলা মা-ইলিশ শিকার করছে।
মৎস্য শিকার বন্ধ থাকাকালে ইলিশ আহরণের কথা স্বীকার করেন চাঁদপুরের স্থানীয় বাসিন্দা ও মৎস্যজীবী রহমত আলী। জরিপদলের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রহমত আলী বলেন, ‘আমি মাছ ধরা বন্ধ রাখলেই কি হইব? অন্যরা তো ঠিকই ধরব। বন্ধ করলে সবাইর ধরা বন্ধ করতে অইব।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার যে ভিজিএফ দেয়, এইটা দিয়া কিছুই হয় না। একটা পরিবারে এক মাসে ৩০ কেজি চাল দিয়ে কী হয়? মোতালেবের বাপে ভিজিএফ পায় নাই, কারণ সে একটি বিশেষ মার্কায় ভোট দেয় নাই। মোতালেবের বাপ তাহলে কী করব?’
ভিজিএফ কার্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা দেখাতে হবে। ভিজিএফের চালের পরিমাণ বাড়াতে হবে বলে গবেষক দল মনে করে।
ভোলার মৎস্যজীবী ওমর আলী মনে করেন, কারেন্ট জাল বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারেন্ট জাল যদি বাজারে পাওয়া না যায়, তাহলে এটা দিয়ে মাছ আহরণ বন্ধ হয়ে যাবে। কারেন্ট জাল খুবই সূক্ষ্ম ও মাছ ধরায় কার্যকর জাল। কারেন্ট জাল ও মশারি জাল উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলে জরিপকারী দল।
মৌসুমের ১ নভেম্বর থেকে ৩১ মে পর্যন্ত জাটকা ধরা যাবে না। অর্থাৎ, ছোট ফাঁসের জাল দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করতে হবে। অথচ সেই সময়ে জাটকা নিধন করা হয়, যার পরিমাণ বছরে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার মে. টন। এই জাটকাগুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। বিজিএফের পরিমাণ আরও সহজ ও যুক্তিযুক্ত পরিমাণ করার কথা বলা হয়। সর্বোপরি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা। জনসচেতনতা বাড়াতে টেলিভিশন, রেডিও ও আধুনিক ডিজিটাল যন্ত্রপাতি, যেমন-প্রজেক্টর ব্যবহার করার কথাও বলা হয় এখানে। ছোট ছোট নাটিকা বানিয়ে মৎস্যজীবীদের দেখিয়ে উদ্যোগ নেওয়া যায়। এ ছাড়া মৎস্যজীবী প্রান্তিক মানুষকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে মাঠপর্যায়ে তাদের নিয়েও পরামর্শ সভা করা যায়।
অধ্যাপক দেওয়ান আলী আহ্সান বলেন, মৎস্যজীবীরা মৎস্য আহরণ শুরুর সময় নৌকা ও জাল কিনতে এবং মৎস্য আহরণ হয় না এমন সময়ে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেন, যা তাঁদের চড়া সুদে শোধ করতে হয়। এই ঋণ শোধ করতে গিয়ে মৎস্য আহরণ করে আয় করা টাকার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাঁদের কৃষক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো নামমাত্র মূল্যে অ্যাকাউন্ট খুলে ঋণ দেওয়া যেতে পারে, যা তাঁরা মাছ ধরার মৌসুমে শোধ করে দেবেন। গবেষক দল আরও মনে করে, বাংলাদেশে মৎস্য সপ্তাহ চলাকালীন ও জাটকা নিধন নিষিদ্ধ থাকলেও অন্যান্য দেশে কিন্তু তা বন্ধ হচ্ছে না। কাজেই পৃথিবীর সিংহ ভাগ ইলিশ যেহেতু মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশে হয়, তাই এই তিন দেশকে নিয়ে একই সময়ে জাটকা নিধন বন্ধ ও প্রজননকালে ইলিশ শিকার বন্ধ রাখলে এর একটা সুফল পাওয়া যাবে। ভারত ও বাংলাদেশের গবেষক দল এ বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছালেও তারা মনে করে, এর বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ইলিশ
ইলিশ নোনা পানির মাছ। বাংলাদেশের মৎস্য-প্রোটিনের ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ পূরণ হয় ইলিশ মাছ থেকে। নোনা পানির মাছ হলেও এরা প্রজননকালে উজানে মিঠা পানিতে গিয়ে স্রোতপ্রবাহে ডিম ছাড়ে। যেমন-পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ অন্য নদীগুলো এদের প্রজননস্থল। অবাধ ভাসমান ডিম থেকে রেণু বেরিয়ে এসব এলাকায় কিছুদিন থাকে, এখানেই খায় এবং বড় হয়। ছয় থেকে ১০ সপ্তাহের মধ্যে এরা ১২-২০ সেমি লম্বা হয় এবং জাটকায় রূপ নেয়। আরও বড় হয়ে এরা ভাটিতে নামতে থাকে এবং সমুদ্রে চলে যায়। একসময় ইলিশ বাংলাদেশের রাজশাহী হয়ে ভারতের এলাহাবাদ পর্যন্ত বিচরণ করত। পৃথিবীতে যত ইলিশ উৎপাদিত হয়, প্রায় তার সবটাই বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক। কাজেই সিংহ ভাগ ইলিশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশেই। বছরে যত ইলিশ উৎপাদিত হয়, তার ৬২-৭০ শতাংশ হয় বাংলাদেশে, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ এবং ভারতে ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশের জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ আসে এই ইলিশ থেকে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই থেকে আড়াই মিলিয়ন জনগোষ্ঠী ইলিশ উৎপাদন হতে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে জড়িত।

No comments

Powered by Blogger.