শিক্ষা ভাবনা ২০০৯: সেক্যুলার জাতি গড়ার রণকৌশল by ড. তারেক ফজল

অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৮ সদস্যের জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি গঠন করেছিল সরকার। সে কমিটি এরই মধ্যে একটি ৯৭ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত খসড়া সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। সরকার আরও জনমত জানার জন্য সেটি ওয়েব সাইটে প্রকাশ করেছে। সংশ্লিষ্ট চূড়ান্ত খসড়া শিক্ষানীতির বিষয়ে ব্যাপক ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
বর্তমান নিবন্ধে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বিষয়ে এ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্যের সূত্রে কয়েকটি মন্তব্য মূল্যায়ন থাকছে। সে সঙ্গে অন্য দু-একটি প্রাসঙ্গিক মূল্যায়নও রয়েছে।
সহজপাঠের জটিল দিক
স্বনামখ্যাত বিজ্ঞানী ও লেখক ড. জাফর ইকবাল আলোচিত শিক্ষানীতি কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্য। তিনি একটি নিবন্ধ লিখেছেন। শিরোনাম ‘শিক্ষানীতির সহজপাঠ’ (প্রথম আলো, ২৬ অক্টোবর ২০০৯)। তাতে তিনি জানিয়েছেন, সরকার তাদের এ কমিটি গঠন করেছিল প্রফেসর শামসুল হক শিক্ষানীতি কমিশন প্রণীত ‘শিক্ষানীতি ২০০০’কে ‘অধিকতর সময়োপযোগী করে পুনর্গঠন’ করার লক্ষ্যে। তিনি লিখেছেন : ‘এটা প্রণয়ন করার আগে আমরা অনেক সংগঠনের সঙ্গে কথা বলেছি, শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী এ দেশের প্রগতিশীল মানুষ কীভাবে চিন্তা করেন, আমরা মোটামুটিভাবে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম এবং আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সেভাবে শিক্ষানীতি ২০০০ পুনর্গঠন করেছি।’ এরই মধ্যে বাংলাদেশের খ্যাতিমান পদার্থ বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. একেএম আজহারুল ইসলাম এক নিবন্ধে নির্দিষ্ট করে জানিয়েছেন, কবীর চৌধুরী শিক্ষানীতি কমিটির শিক্ষানীতিবিষয়ক কোনো প্রশ্নমালা বা কোনো মতবিনিময় সভার বিষয়ে তিনি কিছুই জানার সুযোগ পাননি। ওয়েব সাইটে এ কমিটির চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশের পরই কেবল তিনি এ বিষয়ে জানার সুযোগ পান। এ বক্তব্যের সূত্রে বলা যায়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষানীতি কমিটি ‘প্রগতিশীল’ যে মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছে ও মতবিনিময় করেছে, পদার্থ বিজ্ঞানী প্রফেসর আজহারুল ইসলাম সে ‘তালিকাভুক্ত’ মানুষ নন। এ পর্যায়ে দুটো প্রশ্নের নির্দিষ্ট সুযোগ আছে : এক. বাস্তব জীবনে কথিত ‘প্রগতিশীল মানুষদের’ পরিচয় কী? এবং দুই. যে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর জন্য এ ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ প্রস্তাবিত হয়েছে, কথিত ‘প্রগতিশীল মানুষেরা’ সেই বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর কত শতাংশ?
সংশ্লিষ্ট নিবন্ধে ড. জাফর ইকবাল এরপর লিখেছেন : “খসড়াটা প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়াকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ এটা গ্রহণ করেছেন এবং এটাকে পূর্ণাঙ্গ করার জন্য আরও কী কী বিষয় সংযোজন বা পরিবর্তন করা যায়, সে সুপারিশ করেছেন। অন্য ভাগ এটা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাঁদেরও দু’ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন (খবর পেয়েছি, মসজিদে মসজিদে এ শিক্ষানীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামকে ‘রক্ষা’ করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে)। অন্য ভাগ একে প্রত্যাখ্যান করেছেন এটা যথেষ্ট প্রগতিশীল নয় বলে। তাদের সমালোচনাটা আমার চোখে পড়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায় কোথায় পরিবর্তন করে শিক্ষানীতিটা মোটামুটিভাবে কাজ চালানোর মতো করে ফেলা যায়, তারা সে ব্যাপারে কোনো বক্তব্য রাখছেন না।” ড. জাফর ইকবালের এ পর্যবেক্ষণের সূত্রেও আগের একটি প্রশ্ন এসে যায় এবং তা হলো : বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর কত শতাংশের পক্ষ থেকে তাদের এ প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির পক্ষে সমর্থনসূচক মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে আর কত ভাগ এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অবশ্য ড. জাফর ইকবাল তার কথার ‘ব্রাকেটে’ একটি তাত্পর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী তথ্য জানিয়েছেন পাঠককে এবং তা হলো : “মসজিদে মসজিদে এ শিক্ষানীতিকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামকে ‘রক্ষা’ করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যে ‘মসজিদে মসজিদে’ ড. জাফর ইকবালদের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে এবং সেটিকে ‘ইসলাম ধ্বংসকারী’ (‘রক্ষা’ ধারণার বিপরীত অর্থে) হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেই মসজিদের সঙ্গে এ দেশের কত ভাগ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তা বিবেচনায় রাখতে পারেন ড. জাফর।
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যানকারী ‘প্রগতিশীলদের’ সমালোচনার নির্দিষ্ট বিষয়গুলো ড. জাফরের চোখে পড়েনি বলে জানিয়েছেন। ‘মসজিদভিত্তিক শিশু শিক্ষা’ এবং মাদ্রাসা শিক্ষা অব্যাহত রাখার যে কথা প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে রয়েছে, কথিত প্রগতিশীলরা প্রধানত এ দুটো পয়েন্টে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কারণ, এ দুটোই সেক্যুলার শিক্ষানীতির বিপরীত ও সাংঘর্ষিক ধারণা। এটি বাস্তব বটে। সেক্যুলার শিক্ষানীতি চাইলে মসজিদভিত্তিক শিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষাকে স্বীকার করার নীতিগত সুযোগ নেই। সেক্যুলার অর্থ কী? এ শিক্ষানীতি কমিটির প্রধান প্রফেসর কবীর চৌধুরী গেল নভেম্বর মাসের কোনো একদিন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় এক সাক্ষাত্কারে স্পষ্ট করে বলেছেন : সেক্যুলার মানে ইহজাগতিক। ইহজাগতিক মানে যা কিছু কেবল বর্তমান জীবন বা ইহজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং যা কিছু কোনোভাবেই পরকাল বা পরজীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। পরকাল সংশ্লিষ্ট কোনো প্রসঙ্গ, বিষয় বা ব্যক্তিকে সেক্যুলার বলা যাবে না। প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিটিও নীতিগতভাবে ‘সেক্যুলার শিক্ষানীতি’ করতে চেয়েছেন এর প্রণেতারা। কিন্তু মসজিদভিত্তিক শিশু শিক্ষা (প্রি-স্কুল শিক্ষা) ও মাদ্রাসা শিক্ষার মতো কয়েকটি বিষয় প্রস্তাবিত এ শিক্ষানীতির অংশ হওয়ায় কথিত প্রগতিশীল মানুষের একটি অংশ এ শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে ড. জাফর জানিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট নিবন্ধটির এক পর্যায়ে ড. জাফর লিখেছেন : “অতীতে ধর্মশিক্ষা দিতে গিয়ে ছোট বাচ্চাদের ঘোরতর সাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে, সেরকমটি যেন না ঘটে, তাই শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ধর্ম শিক্ষার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘শিক্ষার্থীর বাংলাদেশের মূল চারটি ধর্ম সম্পর্কে পরিচিতি’ ঘটানো।” দেশের সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে, প্রায় সব দলের রাজনীতিকদের পক্ষ থেকে এবং বিদেশি কূটনীতিক ও বাংলাদেশ ভ্রমণকারীদের পক্ষ থেকে অসংখ্যবার স্পষ্ট করে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক মনের অধিকারী এবং নেহায়েত ধর্মের বিবেচনায় এ দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো সংঘাত ঘটেনি। এ দেশে একই সময়ে রোজা এবং পূজা, রোজার ঈদ এবং পূজা, কোরবানির ঈদ এবং পূজা, মহররমের আশুরা এবং পূজাসহ বুদ্ধপূর্ণিমা ও শুভ বড়দিন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শান্তিময় সহাবস্থানসহ পালিত হয়ে চলেছে। বিভিন্ন ধর্মের প্রতি অনুরাগী বয়সী মানুষরাই যখন এমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলেছেন এই বাংলাদেশে, তখন স্কুলে ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে শিশুদের কবে, কীভাবে এবং কতজন শিশুকে ‘ঘোরতর সাম্প্রদায়িক মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা ‘সফল’ হয়েছে, তার নির্দিষ্ট জবাব ড. জাফরকেই দিতে হবে। বাস্তবে ড. জাফরের মতো কিছু শিক্ষিত ধর্মবিদ্বেষী মানুষ উপযুক্ত প্রতিবাদের অনুপস্থিতির সুযোগে বাংলাদেশের মানুষকে ও বাংলাদেশকে বাংলাদেশ সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতন নন, এমন বিশ্ববাসীর কাছে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন এবং হেয়প্রতিপন্ন করে আনন্দ পেয়ে থাকেন। এ ঘৃণ্য ধারার কার্যকর অবসান জরুরি। এখনও বাংলাদেশে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষার যে নামেমাত্র আয়োজন আছে, তা দ্বারা এ দেশের শিশুমন-শিক্ষার্থীমনকে কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক মনে পরিবর্তনের সুযোগ নেই-আশঙ্কাও নেই।
এরপর ড. জাফর লিখেছেন : ‘তবে আমার মতে, মাধ্যমিক শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটা এসেছে মাদ্রাসা শিক্ষায়। আগে তারা অনেক বিষয়ে কম পড়েই মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের সমান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, ব্যাপারটা তাদের জন্য মোটেও ভালো হয়নি। খুব সহজে অনেক বেশি নম্বর পেয়ে তারা এক ধরনের সুবিধা পেত সত্যি, কিন্তু উচ্চশিক্ষার সুযোগের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতো।... তারা শুধু যে মাধ্যমিক পর্যায়ের অন্যদের সমান লেখাপড়া করবে তা নয়, তারা আসলে একই প্রশ্নপত্রে একই সঙ্গে পরীক্ষা দেবে; শুধু মাদ্রাসার জন্য নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের পরীক্ষা নেবে মাদ্রাসা বোর্ড।’ ড. জাফরের এ বক্তব্যে কয়েকটি বিবেচ্য বিষয় রয়েছে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অনেক বিষয়ে কম পড়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সমমান পেয়ে উচ্চশিক্ষায় (স্নাতক-সম্মান) প্রবেশের সুযোগ পেয়েছে এবং এ সুবিধা তাদের কার্যত ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে ড. জাফর দাবি করেছেন। উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামগুলোতে (স্নাতক-সম্মান) মাদ্রাসার যে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে থাকে তাদের দু’ভাগে ভাগ করা যায় : দাখিল ও আলিম পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশকারীরা একভাগে এবং দাখিলের পর কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশকারীরা অন্যভাগে। শেষভাগের শিক্ষার্থীদের তবু উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে কলেজের শিক্ষার্থীদের সমান বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে পড়ার পরীক্ষা দেয়ার অভিজ্ঞতা থাকছে। প্রথম ভাগের শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষা তথা বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে অনেক কম পড়েই উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশাধিকার পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে থাকে। এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয়টি হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা যদি বলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রতিযোগিতায় মাদ্রাসা থেকে পড়ে আসা প্রার্থীদের জন্য তুলনামূলক নমনীয় ও সহজ পৃথক প্রশ্নের ব্যবস্থা থাকে কি? স্কুল-কলেজের পরীক্ষাগুলো থেকে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনকারী বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অনুমতি দেয়া হয় না। নির্ধারিত ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের মধ্য থেকে মাত্র কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সে সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে একই প্রশ্নে একই ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে কথিত ‘অনেক কম পড়া’ মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্য ঘোষিত হয়, তবে সে সব মাদ্রাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আপত্তি তোলা হবে কোন যুক্তিতে, কিসের ভিত্তিতে? আমার বিবেচনায়, বাংলা-ইংরেজিতে কথিত কম নম্বরের পড়াশোনা করেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে বেশি নম্বরের বাংলা-ইংরোজি পড়া শিক্ষার্থীদের বিপরীতে অধিক যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারায় সে সব মাদ্রাসা পড়ুয়াদের আরও বেশি কৃতিত্বই স্বীকার করা উচিত এবং ন্যায্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পর্যায়ে কয়েকটি বিষয়ে মাদ্রাসা প্রেক্ষাপটের প্রার্থীদের শুধু বাংলা-ইংরেজি বিষয়ে ‘কম নম্বরের পরীক্ষা’ দেয়ার বিবেচনায় অযোগ্য ঘোষণার বিষয়টি এরই মধ্যে উচ্চ আদালতেও উঠেছে এবং একদফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে আদালত রায়ও দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি বিভাগ তাদের অন্যায্য মনোভাব অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। ড. জাফর ইকবাল বিষয়টির এ পর্যায় পর্যন্ত কীভাবে বিবেচনা করছেন, তা জানার আগ্রহ আছে।
এর পরের পর্যায়টি হলো তুলনামূলকভাবে বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে ‘কম নম্বরের’ পড়াশোনা করেও মাদ্রাসা পড়ুয়া যে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে ও ভর্তি হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে স্কুল-কলেজ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে সব মাদ্রাসা প্রেক্ষাপটের শিক্ষার্থীরা চলতে পারে কি অথবা যোগ্যতা প্রমাণে সক্ষম হয় কি? ড. জাফর এ বিষয়ে মন্তব্য করেছেন : ‘কিন্তু উচ্চ শিক্ষার সুযোগের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতো।’ ড. জাফর এ মন্তব্য করেছেন কিসের ভিত্তিতে? এ বিষয়ে কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত আপনার কাছে আছে কি—ড. জাফর?
যদি ড. জাফরের মন্তব্যের পক্ষে পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্তের ন্যায্য সমর্থন থাকে, তবে তার মন্তব্য মেনে নেয়াই ন্যায্য বলে আমি মনে করি। আমার জানা মতে (আমি বিশেষভাবেই কম জানা একজন ব্যক্তি যদিও), সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নিয়ে গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় কোনো গবেষণাকর্ম সম্পন্ন হয়নি। আর আমার ব্যক্তিগত পর্যায়ের অনুসন্ধানের ফল হলো : মাদ্রাসা প্রেক্ষাপটের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্সাহিত হওয়ার মতো ভালো ফলাফল তৈরি করেছে এবং তেমন শিক্ষার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন, বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি কলেজসহ প্রশাসনের বিভিন্ন ক্যাডারে ঈর্ষণীয় সততা ও যোগ্যতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তাই ড. জাফর ইকবালের সংশ্লিষ্ট মন্তব্যটি (‘উচ্চ শিক্ষার সুযোগের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ মাদ্রাসা পড়ুয়াদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া) আমি অগ্রহণযোগ্য মনে করি।
ড. জাফরের এ মন্তব্যটি অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে (এবং তা-ই বাস্তব যখন) এর ভিত্তিতে গৃহীত সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপগুলোও অগ্রহণযোগ্য, অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর বিবেচিত হওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপগুলোর দুটি প্রধান দিক হলো : এক. দাখিল-আলিম পর্যায়ে স্কুল-কলেজের ‘সমান নম্বরের’ বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয় পড়ানো এবং দুই. দাখিল-আলিম পর্যায়ের বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ের উত্তরপত্র মাদ্রাসা বোর্ডের বাইরে অন্য শিক্ষা বোর্ডের আওতায় মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা করা। বর্তমানে দাখিল-আলিম পর্যায়ে এক হাজার নম্বরের আওতায় মাদ্রাসার নিজস্ব বিষয়াদি (আরবি ভাষা, কোরআন-হাদিস ও ইসলামী নীতিমালাবিষয়ক) এবং বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি সাধারণ বিষয় পড়ানো হয়। বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ের নম্বর স্কুল-কলেজের ‘নম্বরের’ সমান করা হলে মাদ্রাসার নিজস্ব বিষয়াদির জন্য অনেক কম নম্বর বরাদ্দ করতে হবে এবং তাতে মাদ্রাসায় দাখিল-আলিম পর্যায়ে পড়ানো জরুরি এমন অনেক বিষয়ে পাঠদান করা কঠিন ও জটিল হয়ে পড়বে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সমাজ চিন্তাবিদ শাহ আবদুল হান্নান এ পর্যায়ে ন্যায্যতই মন্তব্য করেছেন, নতুন নীতির ফলে দাখিল-আলিম পাস করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে ফাজিল-কামিল শ্রেণীর উপযোগী বিষয়াদি পড়ার যোগ্যতা আর থাকবে না এবং তেমন শিক্ষার্থীদের পক্ষে ইসলামী শিক্ষায় ‘পারদর্শী আলিম’ হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই দাখিল-আলিম পর্যায়ে ‘বিদ্যমান পরিমাণ বা নম্বরের’ বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়াদি অব্যাহত রাখাই দরকার। অন্যথায় মাদ্রাসা শিক্ষায় বিপর্যয় অনিবার্য।
মাদ্রাসা বোর্ডের তালিকাভুক্ত পরীক্ষকরা বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে দাখিল-আলিমের শিক্ষার্থীদের বেশি নম্বর দেন বলে যদি বিশ্বাস করা হয়, তবে সে বিষয়ে ‘নিয়ন্ত্রণভিত্তিক সমন্বয়মূলক পদক্ষেপ’ গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতেই পারে। দাখিল-আলিম পর্যায়ের বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ের শিক্ষক-পরীক্ষকরা মাদ্রাসা বোর্ডের সার্টিফিকেট ডিগ্রিধারী ব্যক্তি নন। তারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে সেগুলোর কর্তৃপক্ষ দ্বারাই স্বীকৃতি পেয়েছেন। কেবল মাদ্রাসা বোর্ডের তালিকাভুক্ত পরীক্ষক বলেই তাদের মান-যোগ্যতা বিষয়ে অবমূল্যায়ন গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়। মাদ্রাসা বোর্ডের তালিকাভুক্ত পরীক্ষকদের ‘স্কুল ও কলেজ বোর্ডের’ তালিকাভুক্ত পরীক্ষকদের সঙ্গে বিনিময় করে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার বাংলা-ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়াদির উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিষয়টি কার্যকরভাবে সমন্বয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়?

No comments

Powered by Blogger.