অচল হয়ে পড়েছে টেকনাফ নদীবন্দরঃ ক্ষমতার পেশি আস্ফালন কি থামবে না?


সাতদিন ধরে অচল হয়ে আছে টেকনাফ নদীবন্দর। কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের এমপি আবদুর রহমান বদির সহোদর আবদুল আমিনের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী নদীবন্দরে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে অফিস ভাংচুর ও বন্দরের ডিজিএমকে গুরুতর জখম করে।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বন্দরের কাজকর্ম সেই যে অচল হয়ে পড়েছে, গতকাল পর্যন্ত তা সচল হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। ওইদিন রাতে কয়েকজন অসাধু ব্যবসায়ী রাজস্ব না দিয়ে বিল অব এন্ট্রির অতিরিক্ত ১ হাজার ৬৪৪ কেজি আমদানিকৃত শুঁটকি বোঝাই দুটি ট্রাক জোর করে বন্দর থেকে ডেলিভারি নিতে চেয়েছিল। কিন্তু এ কাজে ব্যর্থ হয়ে তারা এমপির ভাইয়ের নেতৃত্বে গুণ্ডাপাণ্ডা নিয়ে বন্দরে হামলা চালায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অসাধু ব্যবসায়ীরা এমপির ভাইয়ের ‘লোক’ না হলে সে গভীর রাতে এভাবে দলবল নিয়ে হামলা চালাত না। এই অবৈধ কর্মকাণ্ডে অসাধু ব্যবসায়ীরা এবং অসাধু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ওই ব্যবসায়ীরা আবার পাল্টা মামলা করেছে, ধর্মঘট ডেকেছে। ফলে টেকনাফ বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বন্ধ। বন্দরের জেটিতে মিয়ানমার থেকে আমদানি করা ট্রলারভর্তি মাছ এবং আদা, পেঁয়াজ ইত্যাদিতে পচন ধরেছে। স্থানীয় প্রশাসন বিরোধ নিরসনের জন্য সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করেছিল। কিন্তু মীমাংসার সে চেষ্টা বিফলে গেছে।

যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিচার করা হোক না কেন, আমদানি করা পণ্য রাজস্ব পরিশোধ না করে ডেলিভারি নেয়ার চেষ্টা দণ্ডনীয় অপরাধ। দৈনিক আমার দেশ গতকাল এ ব্যাপারে যে খবর ছেপেছে, তাতে বোঝা যায় অসাধু ব্যবসায়ীরা বিল অফ এন্ট্রিতে আমদানি করা পণ্য কম দেখিয়ে দাঁও মারতে চেয়েছিল। এতে বিফল হওয়ায় তারা ক্ষেপে গেছে। ব্যাপারটি অনেকটা ‘চোরের মায়ের বড় গলা’র মতো। এখন তাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টির মীমাংসা করতে হবে! কী সমুদ্রবন্দর, কী নদীবন্দর, কী স্থলবন্দর, কী বিমানবন্দর, সর্বত্রই আমাদের দেশে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার ঘটনা নতুন নয়। এ প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। শুধু রাজস্ব ফাঁকি দেয়া নয়, সে সঙ্গে বাড়ছে অবৈধ পণ্য আমদানির ঘটনাও। এসব ফাঁকিবাজি এমন ব্যাপকতা লাভ করেছে যে, শুধু ‘একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী’র ওপর দায় চাপালে সামগ্রিক পরিস্থিতির খণ্ডিত বিশ্লেষণ হতে বাধ্য। বন্দরে হরেকরকম কারচুপির সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবশ্যই জড়িত। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হাত করতে না পারলে শুধু ব্যবসায়ীদের পক্ষে এ ধরনের দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আমদানি-রফতানিতে জড়িত সব পক্ষের অশুভ আঁতাতের ফলে বন্দরকেন্দ্রিক দুর্নীতি অব্যাহত গতিতে চলছে। সরকার প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। লেনদেনের গোলমাল দেখা দিলে তাদের মধ্যে গণ্ডগোল লেগে যায়। তখন দুর্নীতির কিছু ঘটনা ধরা পড়ে এবং মিডিয়ায় সেগুলো ফলাও প্রচার পায়। কিছুদিনের মধ্যেই আবার পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ হয়ে আসে এবং শুরু হয় মধু ভাগাভাগি।
আলোচ্য ক্ষেত্রে হিসাবটা একটু ভিন্ন। টেকনাফ বন্দর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দেয়া হয়েছে। অর্থাত্ বন্দর পরিচালনা বাবদ যা দেয়ার, তা প্রতিষ্ঠানটি সরকারকে দিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের সেই টাকা উঠিয়ে তার ওপর মুনাফা করতে হবে। তাই তারা রাজস্ব ফাঁকির রেওয়াজ মানছে না বলেই হয়তো বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি এবং হয়রানির অভিযোগ উঠছে। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা তিনদিনের জন্য ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু তাতেই যে বন্দর চালু হবে, তেমন আশা করা যাচ্ছে না। কিন্তু কথা হলো, দেশে তো সরকার আছে, আইন-কানুন আছে; আইন বলবতের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষও আছে। তারা করছেটা কী! একটা বন্দর এক সপ্তাহ ধরে অচল হয়ে আছে, অথচ দেখার কেউ নেই—এ কেমন কথা? তাহলে কি আমাদের ধরে নিতে হবে যে, ক্ষমতাসীনদের পেশি আস্ফাালনই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে?

No comments

Powered by Blogger.