সুপারম্যান by দিলওয়ার হাসান

পেদ্রো হুয়ান গুটিয়েররেসঅনুবাদ-সেই সময় খুব নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হতাম। এর হাত থেকে মুক্ত হয়ে কী করে শান্তিতে থাকা যায়, জানা ছিল না আমার। এখনো জানি না। ধারণা করি, সারা জীবনেও জানা হবে না। তবে এখন এমন কিছু একটা শিখেছি, যাতে খানিকটা পুষিয়ে নেওয়া যায়। স্মৃতির বেদনা থেকে মুক্তি পাওয়া সে এক কঠিন কাজ।


ভালোবাসা আছে—এমন কিছুর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া অসম্ভব।
সব সময়ই ওগুলো নিজের সত্তার অংশ হিসেবে থেকে যাবে। স্মৃতি ভুলে যাওয়া কিংবা ধ্বংস করার ইচ্ছা, যারা বেদনা দিয়েছে তাদের স্মৃতি, হতাশা আর মনোবেদনা কল্পনায় অতীত দিন যাপন করার মতোই দৃঢ় একটা বিষয়।
নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়াটা একান্তই মানবিক একটা বিষয়, আর এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে এর সঙ্গে বসবাস। আবার কেউ সৌভাগ্যবান হলে ব্যাপারটা এমনও হতে পারে, নস্টালজিয়া পরিবর্তিত হয়ে ছড়াতে পারে ভিন্ন দ্যুতি, সেখানে কেউ হয়তো খুঁজে পেয়েছে নতুন কোনো মনের মানুষ, নতুন কোনো শহর, নতুন কোনো যুগ, হয়তো তা ভালো কিংবা খারাপ। আর যে কারণে আমরা প্রতিটি দিন নিজেদের একাকিত্বের ভেতর নিক্ষেপ করতে চাই না, খুঁজে নিতে চাই কাউকে, এড়াতে চাই বাঁধাধরা কাজকর্ম, উপভোগ করতে চাই নতুন সান্নিধ্য।
এখন আমি এ রকম একটা অবস্থার ভেতর আছি। এ রকম একটা উপসংহারই টেনেছি জীবনের জন্য। পাগলামি এসে ভর করছে আর আমি তার করালগ্রাস থেকে ফসকে বেরিয়ে যেতে পারছি। অল্প সময়ের মধ্যে একটা মানুষের জীবনে এত বেশি কিছু ঘটেছে যে তা সামাল দেওয়াই মুশকিল হয়ে পড়েছিল, আর আমি কয়েক মাসের মধ্যেই হাভানা ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। অন্য একটা শহরে থাকছিলাম, কিছু কাজকর্ম করছিলাম। একটা পুরোনো ফ্রিজ আর কিছু জিনিস বিক্রি করে দিয়েছিলাম। বসবাস করছিলাম চূড়ান্ত রকমের পাগল একটা মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটা ছিল একেবারে যাচ্ছেতাই ধরনের। অনেকবার জেলে গিয়েছিল, আর সারা শরীরে ট্যাটু। এর মধ্যে একটা আমার খুব ভালো লাগত, ওটা ছিল তার বাম ঊরুতে। একটা তিরচিহ্ন দিয়ে তার যৌনাঙ্গের দিকে নির্দেশ করা ছিল আর ওখানে লেখা ছিল: খাও আর ফুর্তি করো। দুই নিতম্বের একটাতে লেখা ছিল: ফেলিপের সম্পত্তি, আর অন্যটাতে: ন্যান্সি তোমাকে ভালোবাসি। যিশু কথাটা লেখা ছিল তার বাম হাতে। আঙুলের গাঁটে ছিল তার কজন প্রেমিকের সই।
ওলগার বয়স মাত্র ২৩ হলেও সাংঘাতিক বন্য একটা জীবন যাপন করত সে। বিস্তর গঞ্জিকা আর সব ধরনের মাদক সেবন করত আর যত ধরনের যৌন ক্রিয়াকলাপ আছে সবগুলোতে অভ্যস্ত ছিল। একবার সিফিলিসও হয়েছিল, পরে সেরে যায়। তার সঙ্গে আমার বসবাসের মেয়াদকাল এক মাসের বেশি ছিল না, আর ওটা ছিল খুবই কৌতুককর। ওলগার গা-ঘিনঘিনে ঘরটাতে থাকা মানে এক্সরেটের নীল ছবির জগতে থাকা, আর আমি জেনেওছিলাম অনেক কিছু। ওই এক মাসের মধ্যে যা শিখেছিলাম তা পুঁজি করে অনায়াসে গাইড টু পারভার্সান নামের পুস্তিকা লিখে ফেলতে পারব।
বেশ কিছু টাকাপয়সা নিয়ে হাভানায় ফিরে গেলাম। ফলে কাজকর্ম না করে কটা দিন পার করা যাবে, কিন্তু মিরিয়ামের আস্তানায় যখন পৌঁছালাম সে আমাকে দেখে প্রচণ্ড খেপে উঠল, ‘বেরিয়ে যাও এখান থেকে! ও সবকিছু জানে, তোমাকে পেলে একেবারে খুন করে ফেলবে।’ তার সারা শরীরে ক্ষতের চিহ্ন আর বাম ভ্রুর ওপরে একটা কাটা দাগ। তিন বছর জেল খেটে তার স্বামী এখন মুক্ত। জেল থেকে বেরোনোর পরই তার বন্ধুবান্ধব মিরিয়াম ও আমার ব্যাপারটা তাকে বলে দিয়েছে। সে অবশ্য তার বউকে বেদম মারধর করেছে আর কসাইরা ব্যবহার করে এমন একটা ছুরি হাতে নিয়ে শপথ করেছে যে আমার কল্লা না-কাটা পর্যন্ত বিশ্রাম গ্রহণ করবে না।
লোকটা খুবই ভয়ংকর প্রকৃতির। কাজেই ভাবলাম, সে একটুখানি ঠান্ডা না-হওয়া পর্যন্ত ওই আস্তানা থেকে দূরে থাকব। কিন্তু যাওয়ার মতো কোনো জায়গাই আমার ছিল না। শেষে আনা মারিয়ার বাসায় গেলাম। সবকিছু খুলে বলার পর সে তার বাসার মেঝেতে রাত যাপনের অনুমতি দিল। তবে সত্যি কথাটা হচ্ছে কি, তার সঙ্গে বিয়াত্রিসের রোমান্সে আমি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। টের পেতাম অন্ধকারের ভেতর ওরা রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হচ্ছে। বিয়াত্রিস পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে, এ রকম অবস্থায় আমি কাবাব মে হাড্ডি ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না। এসব সইতে না পেরে আমি এক রাতে কামোদ্দীপ্ত হয়ে ওদের বিছানায় গিয়ে বাতিটা জ্বালিয়েছিলাম আর বললাম, ‘চলো, আমরা তিনজনে মিলে...।’
বিয়াত্রিস যেন আমার হামলার জন্য তৈরিই ছিল। সে বিছানার নিচ থেকে ইলেকট্রিকের একটা মোটা তার বের করে নিয়ে আমার ওপর পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল, ‘হারামজাদা, ভুলে গেছিস, ও আমার গার্লফ্রেন্ড, যা ভাগ এখান থেকে।’ একটা মেয়ে যে এত শক্তিশালী হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। সে প্রচণ্ডভাবে তার দিয়ে বাড়ি মারতে লাগল আমাকে। তারের আঘাতে আমার ঠোঁট কেটে গেল, নাক গেল ভেঙে। মাটিতে ফেলে দিয়ে সে আমার মাথার ওপর বাড়ি মারতে শুরু করল। অর্ধচেতন অবস্থায় শুনতে পেলাম আনা মারিয়া চিৎকার করে আমাকে ছেড়ে দিতে বলছে। তখন তারা আমার মুখের ওপর একটুখানি পানি ঢেলে টেনেহিঁচড়ে করিডরের ওপর নিয়ে ফেলল। তারপর দরজা দিল বন্ধ করে। তখনো বিয়াত্রিস চিৎকার করে বলছিল, ‘অকৃতজ্ঞ, বেজন্মা একটা, কাউকে বিশ্বাস কোরো না, আনা মারিয়া, কাউকে না...।’
শরীর এলিয়ে দীর্ঘক্ষণ ওখানে পড়ে থাকলাম। সারা শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করছিলাম। উঠে বসার শক্তি ছিল না। শেষ পর্যন্ত পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলাম। এখন যদি কোনো কারণে বিয়াত্রিস এখানে এসে পড়ে, তাহলে আবার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। একজন ট্রাকচালকের চেয়েও সে বেশি শক্তপোক্ত।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা দিয়ে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। তারপর গেলাম পার্ক লা ফ্রাতারনিদাদ সমুদ্রসৈকতে। লোকে ভাবল, আমি মাতাল। তারা আমার জিনিস চুরি করতে পকেট হাতড়াতে লাগল, কিন্তু আমি টাকাপয়সা যা কিছু ছিল সব আনা মারিয়ার ওখানে একটা বইয়ের ভেতর রেখে এসেছিলাম।
সকাল হলে ইমারজেন্সি হাসপাতালে গেলাম। তারা আমাকে সামান্যই চিকিৎসা দিতে পারল। হাতে কোনো টাকাপয়সাই ছিল না। এত শিগগির তা আনা মারিয়ার ওখান থেকে আনাও যাবে না। কয়েক দিন অপেক্ষা করাই ভালো
এর মধ্যেই আমার অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়ে পড়েছিল। সারা শরীরে নোংরা লেগে আছে। শেভ করা হয়নি। মরিয়া হয়ে ভিক্ষা করার কথা ভাবলাম। সালুদ ই কাম্পানো এলাকায় অবস্থিত লা কারিদাদ গির্জার দরজার কাছে গিয়ে বসে পড়ে হাত প্রসারিত করলাম। ইতিমধ্যে ওখানে বসে থাকা এক বুড়িকে সবাই ভিক্ষা দিচ্ছিল। তার কাছে সান লাজারোর ছবি ও বাণী লেখা একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স ছিল। ওখানে লেখা ছিল সে একটা প্রতিজ্ঞা পালন করছে। গির্জার তালা যখন লাগিয়ে দেওয়া হলো, আমার হাতে সামান্য কটা মুদ্রা। ভীষণ খিদে পেয়েছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় কিছুই খাইনি।
কয়েকটা বাড়িতে গেলাম ভিক্ষা চাইতে। কিন্তু অনাহার মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল সর্বত্র। ১৯৯৪ সালে হাভানাতে সবাই ছিল ক্ষুধার্ত। এক বৃদ্ধা কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা আমাকে এক টুকরা কাসাভা দিল।
শরীরের ব্যথা প্রশমিত হওয়ার আগপর্যন্ত এভাবেই কটা দিন পার করে দিলাম। তারপর রাস্তা থেকে একটা লোহার রড কুড়িয়ে নিয়ে প্যান্টের তলায় লুকালাম আর আনা মারিয়ার বাসার দিকে রওনা হলাম। তখন ছিল সকালের প্রথম দিক। হিসাব করে দেখলাম, বিয়াত্রিস তখন কাজে থাকবে।
দরজায় টোকা মারলে আনা মারিয়া খুলে দিল। আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করল সে, কিন্তু লোহার রড দিয়ে আমি তা আটকে দিলাম। তাকে ধাক্কা দিয়ে পথ করে ভেতরে ঢুকলে চিৎকার করে উঠল সে। সিংক থেকে ছুরি আনার জন্য দৌড়ে গেল।
‘শান্ত হও, আনা মারিয়া। এখানে কিছু করতে আসিনি। একটা জিনিস রেখে গেছি, ওটা নিয়েই চলে যাব।’
‘তুমি এখানে কিছুই রেখে যাওনি। বের হও। শিগগির বের হও, এখান থেকে। সব পুরুষই এক। একটা ষাঁড়। বিয়াত্রিস এখানে থাকলে তোমার মাথা গুঁড়িয়ে দিত...।’
ততক্ষণে বইটা আমার হাতে এসে গেছে। খুলে দেখলাম, টাকাপয়সা সব ঠিকঠাকই আছে। আমার দিকে তাকিয়ে জ্বলজ্বল করছে যেন। ওগুলো পকেটে ভরে দ্রুত কেটে পড়তে লাগলাম। মুহূর্তের মধ্যেই আনা শান্ত হয়ে গেল। আর আমি চলার গতি দিলাম বাড়িয়ে। সবকিছু রাহাজানি করে নিয়ে যাচ্ছি এ রকম কথা বলে যদি শোরগোল তোলে সে, তাহলে আর রক্ষে থাকবে না।
প্রথমে এক বোতল রাম কিনলাম। দীর্ঘ সময় কোনো পানীয় আমার পেটে পড়েনি। একজন পরিচিত লোকের বাড়ি থেকে কিনলাম ওটা। ব্ল্যাক মার্কেটের রাম। দাম একটু বেশি, তবে বেশ ভালো। আমরা দুজনে গলা ভেজালাম। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার এমন করুণ দশা কেন। আমি তাকে বেশি কিছু না বলে ঘটনার একটুখানি আভাসমাত্র দিলাম।
‘দেখাশোনার জন্য একজন বুড়োকে খুঁজে নিচ্ছ না কেন? ওই কোনায় একজন বৃদ্ধ বসে। অসুস্থ। একাই থাকে। আশির কাছাকাছি বয়স—জারজ সন্তান, ধৈর্য ধরলে কাজেও লেগে যেতে পারে। মাস কয়েক আগে তার স্ত্রী মারা গেছে। ক্ষুধার জ্বালায় প্রায় মরার উপক্রম হয়েছিল। তার সঙ্গে গিয়ে থাক, তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে যত্নআত্তি করো। খাবারদাবার এনে দাও, মরে গেলে ওর বাড়িটা তুমি পাবে। রাস্তার জীবনের চেয়ে ভালো একটা জীবন জুটবে তোমার।’
বোতলটা শেষ হয়ে গেলে আরেক বোতল কিনলাম। একেবারে থুত্থুরে বুড়ো, তবে খুব দৃঢ়চেতা। কৃষ্ণাঙ্গ। জীর্ণশীর্ণ তার শরীর, তবে ভেঙে পড়েনি। তার বাসার নম্বর ৫৫৮ সান লাজারো। একটা হুইলচেয়ারে রোজ দরজার সামনে নীরবে বসে থাকে। রাস্তার যানবাহনের চলাচল দেখে, ধোঁয়ার গন্ধ শোঁকে। স্টোরের চেয়ে সামান্য কম দামে সিগারেট বিক্রি করে। আমি এক প্যাকেট কিনলাম। প্যাকেট খুলে তাকে সাধলাম, নিল না। রাম সাধলাম, তাও ফিরিয়ে দিল। আমার মেজাজ খুব ভালো ছিল, কেননা পকেটে কিছু টাকাপয়সা, এক বোতল রাম আর এক প্যাকেট সিগারেট আছে। নতুন এক আলোতে পৃথিবীকে প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। সে কথা বুড়ো লোকটাকে জানালাম, আর তার সঙ্গে কথা বললাম কিছুক্ষণ। তখনো আধা বোতলের মতো রাম ছিল। আমার ভেতর তখন কথা বলা আর আমোদের আমেজ। ঘণ্টা খানেক পরে, বেশ ক পেগ মদ পান শেষে (শেষ পর্যন্ত সে আমার মদের অফার গ্রহণ করেছিল) বৃদ্ধ লোকটা নিজেকে আমার কাছে উন্মোচন করল। জানাল, সে একটা থিয়েটারে কাজ করত।
‘কোথায় কাজ করতেন, মার্তিতে?’
‘না। সাংহাইয়ে।’
‘ও হো, কী করতেন সেখানে? শুনেছি ওখানে নগ্ন প্রদর্শনী হতো। তবে বিপ্লবের সূচনালগ্নে ওটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
‘হ্যাঁ, তবে বেশি দিন ওখানে কাজ করিনি। আমি ছিলাম সুপারম্যান। আমার জন্য একটা পোস্টার টাঙানো থাকত—এই থিয়েটারে আছে শুধু একজন সুপারম্যান, আর কোথাও এমনটা পাওয়া যায় না। তুমি কি জানো, উত্তেজিত অবস্থায় আমার ওই বিশেষ অঙ্গটি হতো দেখার মতো? খাপছাড়া যাকে বলে। ওরা বিজ্ঞাপনে লিখত: খাপছাড়া এক বিশাল লিঙ্গের অধিকারী, সুপারম্যান...কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাদের মাঝে আবির্ভূত হবে!’
‘আপনি স্টেজে থাকতেন?’
‘অবশ্যই। ঢিলে হাতাহীন মখমলের একটা জামায় মোড়ানো থাকত আমার শরীর। স্টেজের ঠিক সামনে বসানো হতো আমাকে। তারপর শরীর থেকে মখমলের আভরণটা সরিয়ে নেওয়া হতো। তখন আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ, একটা চেয়ারের ওপর বসা, দর্শকদের দেখছি বলে মনে হতো, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা ছিল না। উইংসের আড়ালে শুয়ে থাকা সুন্দরী একটা নগ্ন মেয়ের দিকে থাকত আমার চোখ।
‘প্রতি রাতেই কি এটা করতেন?’
‘হ্যাঁ, প্রতি রাতেই, কোনো রাতে বাদ পড়ত না। টাকাপয়সাও খুব ভালো পেতাম। আমার মুখ থেকে গোঙানির মতো শব্দ বের হতো আর উত্তেজনায় চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যেতাম, যেন আমার ওপর পাথর ছোড়া হয়েছে। বেজন্মাগুলো আমার আনন্দে মেতে উঠত আর মঞ্চের ওপরে টাকা দোলাতে দোলাতে চিৎকার করে উঠত, ব্রাভো, ব্রাভো সুপারম্যান! তারা ছিল আমার ফ্যান আর আমি ছিলাম তাদের খেলুড়ে। শনিবার আর রোববারগুলোতে আয় বেশি হতো, কারণ সেদিন হল কানায় কানায় ভরে যেত। আমি এমন বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলাম যে সারা বিশ্ব থেকে আগত ট্যুরিস্টরা আমাকে দেখতে আসত।’
‘এসব ছেড়ে দিলেন কেন?’
‘কারণ জীবন অমনই। কখনো জোয়ার, কখনো ভাটা, কখনো উন্নতি, কখনো অবনতি। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল। বয়স বেড়ে বেড়ে তখন ৩২ পেরিয়ে গেলাম। তখন ওই অঙ্গটি আর আগের মতো উত্থিত হতো না। এমন একটা সময় এল, যখন এসবের প্রতি তেমন মনোযোগও স্থাপন করতে পারতাম না। তত দিনে অর্ধ-উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ দীর্ঘদিন আমার মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়েছে। স্প্যানিশ ফ্লাই, জিনসেঙ, চীন দেশের ওষুধ জানজা, টনিক এসব খেতাম। আমার কাজেও আসত। তবে এগুলো আমার মধ্যে স্নায়বিক দুর্বলতার সৃষ্টি করত। আমার ওই কাজ আমার কাছ থেকে কতটুকু নিয়ে নিত, কেউ জানত না। স্ত্রী ছিল আমার। কিছুদিন আগে মারা গেছে। হাভানায় আসার পর থেকে আমার সঙ্গেই ছিল সব সময়। ওই দীর্ঘ সময়ে তার সঙ্গে কখনো মিলিত হইনি। আমাদের কোনো ছেলেপুলেও হয়নি। আমার স্ত্রী ছিল সন্ন্যাসিনীর মতো। সে জানত, আমরা যদি যৌনসংসর্গ করি, তাহলে রাতের বেলায় সাংহাইয়ে ওই কাজ করা সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। সুপারম্যান শো দেখানোর জন্য ২৪ ঘণ্টাই আমাকে আমার শক্তি সঞ্চয় করতে হয়েছে।’
‘আশ্চর্য রকমের আত্মনিয়ন্ত্রণ বলা যায়, তাই না?’
‘ব্যাপারটা এমন ছিল—হয় সংযম, না-হয় অনাহার। ওই সময় অর্থ উপার্জন সহজ ব্যাপার ছিল না।’
‘টাকাপয়সা রোজগার এখনো শক্ত কাজ।’
‘হ্যাঁ, বিষ্ঠার বোঝা বওয়ার জন্যই গরিবদের জন্ম।’
‘তারপর কী হলো?’
‘কিছুই না। আরও কিছুদিন থিয়েটারে থাকলাম। ছোটখাটো কাজ করতাম। মঞ্চে উঠে সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে ঠাট্টা-মশকরা করতাম। লোকে সেটা পছন্দ করত। তারা বিজ্ঞাপন দিত: বিশাল লিঙ্গ আর সোনালি সুন্দরী, জগতের শ্রেষ্ঠ কামুক দম্পতি। কিন্তু ওগুলো আগের তুলনায় ছিল অতি ক্ষুদ্র ব্যাপার। খুব কম আয় হতো। তখন বাধ্য হয়ে একটা সার্কাসে যোগ দিয়েছিলাম। ক্লাউন ছিলাম। এ ছাড়া সিংহের যত্নআত্তি করতাম। ভারসাম্যের খেলাতেও অংশ নিতে হতো। কমবেশি সবকিছুই করতে হতো আমাকে। আমার স্ত্রী দরজির কাজ আর রান্নাবান্না করত। বছরের পর বছর ধরে এসবই করে গেছি। শেষ বয়সে এসে জীবনটা হয়ে গেছে উন্মাদগ্রস্ত। অনেক অপ্রত্যাশিত বাঁকে ভরা এই জীবন, বুঝলে কিনা।’
আমরা আরেক দফা পান করলাম আর রাতটা তার সঙ্গে কাটালাম। পরের দিন আমি তাকে কিছু পর্নো ম্যাগাজিন উপহার দিলাম। সুপারম্যান লোকটা ছিল পেশাদার পিপিং টম। সে-ই ছিল পৃথিবীতে একমাত্র লোক, যে অন্যদের যৌনমিলন দেখে জীবিকা নির্বাহ করত। ভাবলাম পর্নো ম্যাগাজিনগুলো তার ভেতর থ্রিল জাগাবে। সে পাতা ওল্টাতে লাগল। ‘৩৫ বছর ধরে এসব জিনিস এ দেশে নিষিদ্ধ। বস্তুত, এ দেশে কোনো মানুষের প্রাণখুলে হাসাও নিষেধ। এগুলো আমার বরাবরই ভালো লাগে। আমার স্ত্রীও পছন্দ করত। ফরসা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা দুজনেই উদ্দীপিত হতাম।’
‘আপনার স্ত্রী কি কালো ছিল?’
‘হ্যাঁ, তবে সে ছিল খুবই পরিশীলিত। সেলাই আর এমব্রয়ডারি ভালো জানত। ধনী লোকদের বাড়িতে রান্নার কাজ করত। নিছক কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের মতো ছিল না সে। আমার নেতৃত্ব মেনে নিত।’
‘এখন আর এসব ম্যাগাজিন ভালো লাগে না আপনার? রেখে দিন, উপহার হিসেবে দিলাম।’
‘না, না বাপু, এগুলো দিয়ে এখন আমি কী করব?’
কেটে যাওয়া অঙ্গ ঢাকা ছিল যে কম্বলটা দিয়ে, সেটি সে সরাল তার পুরুষাঙ্গ আর অণ্ডকোষদ্বয় এখন আর নেই। নিচের অঙ্গ কেটে বাদ দেওয়ার ফলে সবকিছুই গেছে। কোমরের হাড় অবধি সবটুকু অংশ কাটা গেছে। কিছুই আর বাকি নেই এখন। তার পুরুষাঙ্গটি যেখানে ছিল, সেখানে রাবারের একটা নল লাগানো হয়েছে। যেটি দিয়ে প্রস্রাব ঝরে ঝরে তার কোমরের সঙ্গে বাঁধা একটা প্লাস্টিকের থলেতে এসে পড়ছে।
‘কী হয়েছিল আসলে?’
‘খুব উঁচুমাত্রার ব্লাডসুগার। গ্যাংগ্রিন হওয়ার কারণে দুটো পা-ই কেটে বাদ দিতে হয় শরীর থেকে। এমনকি অণ্ডকোষ দুটি পর্যন্ত। এখন কোনো অণ্ডকোষই আমার নেই, হা হা হা। আমি বরাবরই অণ্ডকোষওয়ালা ছিলাম। বুঝলে না, শত হলেও সাংহাইয়ের সুপারম্যান! কিন্তু এখন তো আমার সব শেষ। তবে আমার যা আছে, তা কেউ কোনো দিন নিতে পারবে না।’
অন্তর দিয়ে হাসল সে। তাতে ব্যঙ্গোক্তির কোনো আভাস ছিল না। ওই বৃদ্ধের সান্নিধ্যে এসে বুঝলাম নিজের ওপর বিদ্রূপের হাসি কেমন করে হাসতে হয়, তা সে জানে। ব্যাপারটা পছন্দ হয়েছে আমার। শিখতে পারলাম, নিজেকে কী করে ব্যঙ্গ করতে হয়—সব সময়, নিজের অণ্ডকোষ দুটো কাটা পড়লেও!

লেখক পরিচিতি: পেদ্রো হুয়ান গুটিয়েররেসের জন্ম কিউবার মাতানজাসে ১৯৫০ সালে। তিনি বেড়ে ওঠেন পিনার দেল রিওতে। ১১ বছর বয়সের সময় জীবিকা নির্বাহের জন্য আইসক্রিম ও সংবাদপত্র বিক্রির কাজ নেন। নানা পেশার সঙ্গে জড়িত হন। তিনি ছিলেন সৈনিক, সাঁতারু, কৃষিশ্রমিক, টেকনিশিয়ান, রেডিও-কথক আর সাংবাদিক।
মূলত ঔপন্যাসিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে ডার্টি হাভানা ট্রিলোজি, দ্য কিং অব হাভানা, ট্রপিক্যাল অ্যানিম্যাল, দ্য ইনসার্টিবল স্পাইডারম্যান ও ড্যামিট। ইতিমধ্যে দুটি পুরস্কার পেয়েছেন গুটিয়েররেস।

No comments

Powered by Blogger.