রং চড়ানো ইতিহাস-৩ by মাহমুদ শামসুল হক


ইতিহাস নিয়ে মশকরা করার কোনোই অবকাশ নেই। ইতিহাসকে বিকৃত, বিতর্কিত এবং জ্ঞাতসারে খণ্ডিত করা পাপ। দেরি হলেও ইতিহাসই এসব গুনাহগারির দাদ নেয় নির্মম হাতে। মাঝখান থেকে ক্ষতি হয়ে যায় পাঠকের। ভ্রান্ত তথ্য পৌঁছে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে এ ধরনের বহুল আলোচিত-পঠিত রং চড়ানো দুটি তথ্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হচ্ছে এখানে।

কতিপয় ইংরেজ ঐতিহাসিক লিখেছেন, ইংরেজ বণিকরা ভারতবর্ষে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার সনদ পেয়েছিল মোগল সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। এর সত্যতা নিয়ে ইতিহাস গবেষকরা পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু এই তথ্যের সঙ্গে একাধিক ইংরেজ ইতিহাস লেখক ভুল তথ্য যোগ করতেও কসুর করেননি। তারা জানিয়েছেন, শাহজাহানের মেয়ে শাহজাদী জাহানারার শরীরের বিভিন্ন জায়গা অগ্নিদগব্দ হলে তার চিকিত্সা করেছিলেন ইংরেজ চিকিত্সক সার্জন বৌটন। বিনিময়ে সম্রাট তাদের বিনাশুল্কে বঙ্গদেশে বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। ভারতবর্ষের স্কুলপাঠ্য ইতিহাসে দীর্ঘদিন এ তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। ফলে একটি বিতর্কিত তথা মিথ্যা বার্তা পৌঁছে গেছে সাধারণের কাছে। ইতিহাস গবেষকদের মতে, মোগল হেরেমে ইংরেজের প্রবেশাধিকার প্রমাণ করার জন্যই এ ধরনের মিথ্যাচার করা হয়েছে। মোগলের অন্দরমহলে বেগম ও শাহজাদীদের সামনে উপস্থিত হওয়ার মধ্যে একটা কৃতিত্বের বিষয় রয়েছে; যা মোগল আভিজাত্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সম্রাট আকবর থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মোগলের জেনানা মহলে ঘনিষ্ঠ স্বজনদেরও প্রবেশাধিকার ছিল না। এই স্বাতন্ত্র্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতলবেই ইংরেজ লেখকরা বৌটনকে চিকিত্সার্থে হেরেমে প্রবেশের কাল্পনিক গল্প ফেঁদেছেন। বলা হয়েছে, ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট-তনয়া জাহানারার গায়ের কাপড়ে আগুন লেগে শরীরের অনেক জায়গা দগ্ধ হয়। এক পর্যায়ে ইংরেজ বণিক দলের চিকিত্সক বৌটন দগ্ধ ক্ষতে ওষুধ প্রয়োগ করে জাহানারাকে সুস্থ করে তোলেন এবং এর বিনিময়ে সম্রাটের কাছ থেকে বঙ্গদেশে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি পান। ‘Orme’s History of the Military Transaction of the British Nation in Hindustan’ (Vol.11, P.8)-এ এই তথ্য বর্ণিত হয়েছে। এটি প্রকাশিত হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাত্ ঘটনার প্রায় একশ’ বছর পর। একই তথ্যের উল্লেখ করা হয়েছে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত স্টুয়ার্টের ‘বাংলার ইতিহাস’-এ (Stewart’s History of Bengal) । কিন্তু ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ‘Modern Review’ পত্রিকার আগস্ট সংখ্যায় জাহানারার একজন নয়, একাধিক চিকিত্সকের তালিকা দিয়েছেন ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার। তবে ড. দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘বৃহত্বঙ্গ’ গ্রন্থে আলোচ্য ইংরেজ ঐতিহাসিকদের তথ্যেরই পুনরুল্লেখ করেছেন। এসব তথ্যকে ভ্রান্ত বলে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন মৌলবী আবদুল ওলী ‘বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটি’ থেকে প্রকাশিত জার্নালে। ‘Surgeon Boughton and the grant of privilages to the English Trader’ প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ করেছেন, বৌটন জাহানারাকে চিকিত্সা করেননি অথবা সম্রাটের কাছ থেকে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার কোনো সনদও পাননি।
জাহানারার চিকিত্সা সম্পর্কে একটি গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়েছেন বারিদবরণ ঘোষ, ১৯৮৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মোগল সম্রাটের অন্দরমহল’ গ্রন্থে। এতে বলা হয়েছে, ১৬৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ মোগল হেরেমে নর্তকী গুলরুখ বাইয়ের ওড়নায় আগুন ধরে যায় চেরাগের বাতিদান থেকে। প্রিয় নর্তকীকে বাঁচাতে গিয়ে আগুন ধরে জাহানারার পরিধেয় বস্ত্রে। প্রায় নয় মাস লাগাতার চিকিত্সা চলে, সমস্ত চিকিত্সক-বৈদ্য ব্যর্থ হলে আরিফ নামে জনৈক ক্রীতদাস একটি মলম তৈরি করেন গাছগাছড়া থেকে। সেই মলম ব্যবহার করেই আরোগ্য লাভ করেন জাহানারা। কাজেই ‘বৌটন’ সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে ইতিহাস পাঠককে।
ইতিহাস নিয়ে আরেকটি বহুল আলোচিত ও পঠিত মিথ্যাচার করেছেন ইংরেজ ইতিহাস লেখকরা। বাঙালি লেখকদেরও অনেকে তাদেরই অনুসরণ করেছেন। এই অতিরঞ্জিত কাহিনীটি ‘অন্ধকূপ হত্যা’ নামে দীর্ঘদিন স্কুলপাঠ্য ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলাহকে। পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিক গবেষণায় এই জঘন্য মিথ্যাচার পরিত্যক্ত হয়েছে। কাহিনীটি ছিল ইংরেজ কর্মচারী হলওয়েলের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত। হলওয়েলের কাহিনীতে বলা হয়েছে, ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করে বিনা অনুমতিতে তৈরি ইংরেজদের ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ দুর্গ অধিকার করেন। এর আগের দিনই ইংরেজ গভর্নর ড্রেক অন্যান্য ইংরেজকে নিয়ে অন্যত্র সটকে পড়েন। নবাবের হাতে বন্দি হয় ১৪৬ জন ইংরেজ। তাদের আবদ্ধ করা হয় ১৮ বাই ১৪ ফুট আয়তন বিশিষ্ট ‘অন্ধকূপ’ নামের কক্ষে। ফলে ১২৩ জন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। দীর্ঘদিন এই মিথ্যাচার সত্য তথ্য হিসেবে গণ্য ছিল। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক গবেষণায় ধরা পড়ে, আলোচ্য আয়তনের কক্ষে বইয়ের মতো সাজিয়ে রাখলেও ১৪৬ জনকে রাখা সম্ভব নয়। নবাবকে নৃশংস হিসেবে প্রতিপন্ন করতে গিয়ে হিসাব কষতে ভুল করেছিলেন অতি চালাক ইংরেজ লেখকরা। এ সম্পর্কে সাবেক কংগ্রেস সভানেত্রী অ্যানি বেসান্ত বলেছেন, ্তুএবড়সবঃত্ু ফরংঢ়ত্ড়ারহম ধত্রঃযসবঃরপ মধাব ষরব ঃড় ঃযব ংঃড়ত্ু্থ। তাছাড়া গভর্নর ড্রেক সবাইকে নিয়ে পালিয়ে গেলে ১৪৬ জন ইংরেজ সেখানে এলো কোত্থেকে? এভাবে ইংরেজদের এক কক্ষে আবদ্ধ থাকা এবং শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যুর কাহিনীকে প্রামাণিক তথ্য হাজির করে পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছেন ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্র তার ‘সিরাজউদ্দৌলাহ’ গ্রন্থে।

No comments

Powered by Blogger.