বিদেশ সফরে রেকর্ডঃ ঘর সামলাবে কে?


মহাজোট সরকারের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে অপ্রাপ্তির দিকটাই ভারি দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে সরকারের প্রচেষ্টা হতাশাজনকই বলতে হবে। দ্রব্যমূল্য, বিনিয়োগ, আইন-শৃঙ্খলা, দলীয়করণ, জ্বালানি সঙ্কটসহ জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে সফলতার দাবি কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না।
মহাজোটের মহাবিজয়ের পর সরকারের এমন পরিণতি অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হবে। তবে অন্তত একটি ক্ষেত্রে সরকার রেকর্ড সৃষ্টির দাবি করতে পারে। সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফর। এর বিপরীতে বিদেশ থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে স্বল্পসংখ্যকের আগমন চোখে পড়ার মতো। গতকালের আমার দেশ-এ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত বছর প্রধানমন্ত্রী ১১ বার বিদেশ সফরে গিয়ে মোট ৫০ দিন কাটিয়েছেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাটিয়েছেন প্রায় ৪ মাস। তিনি ৩৪ বার বিদেশ সফরে গেছেন। আগস্ট মাস ছাড়া প্রতিমাসেই তিনি দেশের বাইরে গেছেন। বছরব্যাপী একাধিক দেশে, একাধিকবার এভাবে সফরে বাংলাদেশের আর কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী উত্সাহী ছিলেন বলে জানা যায়নি।

গত বছরের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নিয়ে ২০ এপ্রিল সৌদি আরবে ৫ দিনের জন্য যাওয়া ছিল প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বিদেশ সফর। এই উদ্বোধনী সফর নিয়ে অনেক আশার কথা বলা হয়েছিল। সে সময় সৌদি বাদশাহর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর সেখানকার বাংলাদেশী শ্রমিকদের ‘আকামা’ সমস্যা সমাধানের সাফল্য দাবি করা হয়েছে। তবে প্রবাসীদের কাছে এ সাফল্য ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। এখনও তারা আকামা সমস্যায় জর্জরিত। তারপর জুন, জুলাই, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর প্রত্যেক মাসেই প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় সফরে গেছেন বিভিন্ন দেশে। প্রথম সফরের মতোই এসব সফর থেকেও তিনি দেশের জন্য তেমন কিছু এনেছেন দেখা যায়নি। বিভিন্ন দেশে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও সম্মেলনের সচিত্র খবর ছাড়া দেশবাসী কিছু পেয়েছে বলা যাবে না। ডিসেম্বরে কোপেনহেগেনের জলবায়ু সম্মেলন থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করলেও বিশ্বনেতারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ৩৪ বার বিদেশ সফর নিয়ে তো ইতিহাস লেখা যায়। প্রতিবেশী ভারত, মিয়ানমার ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও মরিশাসে দ্বিপাক্ষিক সফর ব্যতীত বিভিন্ন ধরনের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও সম্মেলনে অংশ নিতেই তিনি প্রায় প্রতিমাসে বিদেশে ছুটে গেছেন। কোনো কোনো সময় তিনি ৪-৫টি দেশে গেছেন এক মাসে। এই রেকর্ডসংখ্যক বিদেশ সফরের সফলতা কিঞ্চিতই বলতে হয়। মরিশাস থেকে ১১ হাজার বাংলাদেশীর ফেরত আসা ঠেকানো ছাড়া আর কোনো সাফল্য নেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানিতে ধস ঠেকানো যায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর সত্ত্বেও মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানি বন্ধই রয়ে গেছে। মহাজোট সরকারের এক বছরে জনশক্তি রফতানি অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ সময়কালে দেশে ফেরত এসেছে প্রায় আড়াই লাখ প্রবাসী শ্রমিক। প্রবাসীদের লাশ আসার সংখ্যাও বেড়ে গেছে। এসব সমস্যা সমাধানে কিছুই অগ্রগতি হয়নি। তবে ভারতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একাধিক সফর এবং ভারতীয় প্রতিপক্ষের পাল্টা সফরের কিছুটা ফল এরই মধ্যে দেখা গেছে। বাংলাদেশ থেকে উলফা চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ নেতা ও লুকিয়ে থাকা পলাতকদের গোপনে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার খবর দু’দেশেই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে ৩টি চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা জানা গেছে। ভারতের এসব দাবি পূরণের বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে অবশ্য নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রেকর্ডসংখ্যক বিদেশ সফরের বিপরীতে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে উল্লেখযোগ্য তেমন কেউ বাংলাদেশ সফর করেননি। অর্থাত্ একতরফা বিদেশ সফর নিয়েই মহাজোট সরকারকে প্রথম বছর কাটাতে হয়েছে। এর পেছনে রাষ্ট্রের মোট কত টাকা খরচ হয়েছে, সেটা জনগণ কোনোদিনই জানবে না কিন্তু এ থেকে ফলাফল কী হবে বা আদৌ হবে কিনা, সেটা জানার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। সামনের বছরগুলো যদি এমনি নিষম্ফল সফরে ভরপুর থাকে, তবে হয়তো দেখা যাবে যে, ঘর সামলানোর কেউ নেই। বলা বাহুল্য, এ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলা যায় না।

No comments

Powered by Blogger.