ভারত-কংগ্রেসের সঙ্গে আঞ্চলিক দলের সংঘাত by জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী

অন্যদিকে কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়াপুত্র এবং দেশের আগামীদিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনেকের কাছেই বিবেচিত রাহুল গান্ধীকে দেশের নেতা হিসেবে দেখার জন্য অনেক কংগ্রেস নেতাকর্মী অধীর হয়ে আছেন। তারা মনে করেন, দুর্নীতি এবং আরও অনেক সমস্যায় জর্জরিত বর্তমান কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট সরকারকে সংকট থেকে তুলে আনার জন্য প্রয়োজন আকর্ষণীয় নেতৃত্ব।


তারা মনে করেন, মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে রাজনৈতিক গতিশীলতা নেই এবং রাহুল গান্ধীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে সরকারে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তবে রাহুল নিজে এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ
দেখাচ্ছেন না


বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের বর্তমান বহুদলীয় ইউপিএ সরকার কোনো বড় ধরনের সংকটের সম্মুখীন নয়, যদিও বিভিন্ন কারণে দুর্বল অবস্থানে বিচরণ করছে। প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ব্যক্তিগতভাবে এখনও যথেষ্ট সম্মানিত, যদিও তার সরকারের কার্যক্রম দুর্নীতিসহ অন্যান্য কিছু কারণে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ নির্বাচনের আরও বেশ দেরি, অর্থাৎ আগামী লোকসভার ভোটপর্ব ২০১৪ সালের প্রথমার্ধে হওয়ার কথা। দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনেরও তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তা সত্ত্বেও এমনি একটি ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে, এই সরকার হয়তো পূর্ণ মেয়াদ পার করতে পারবে না। অনেকেই মনে করেন, পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে সরকার আগাম নির্বাচন দিয়ে স্বীয় অবস্থান দৃঢ় করার চেষ্টা করতে পারে। আবার এমন অবস্থারও উদ্ভব হতে পারে, যার কারণে মধ্যবর্তী ভোট অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে। এটা সত্য, আপাতদৃষ্টিতে সরকারের পুরো মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনাই বেশি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তবু মেয়াদ পূর্তির আগে ইউপিএ সরকারের বিদায় ঘটলে, তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। রাজনীতির বিচিত্র গতি-প্রকৃতির কারণেই এটা হতে পারে। তবে এমনি পরিস্থিতি যে হবেই, সেটাও অনেকটা অনুমাননির্ভর এবং বিভিন্ন বিশ্লেষণের কারণে মনে করা হচ্ছে। কথা হলো, কেন মনে করা হচ্ছে যে সরকার হয়তো পুরো মেয়াদে শাসন করতে পারবে না? এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, যৌক্তিক কারণ রয়েছে বলেই এমন ধরনের বিশ্লেষণ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এই মূল্যায়নের পটভূমি খুব শক্ত না হলেও নিঃসন্দেহে বাস্তবতাবহির্ভূত নয়।
গত এক বছরে বেশ কয়েকবার এমনই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন পদত্যাগ করতে পারেন। শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। তবে সততা এবং নীতিমালার প্রতি অনুরাগী হিসেবে পরিচিত মনমোহন যে একাধিকবার স্বীয় পদত্যাগে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। বিশেষ করে সাড়া জাগানো মোবাইল টেলিফোন সংক্রান্ত দুর্নীতির ঘটনায় দেশের সুপ্রিম কোর্ট যখন সময়মতো দোষীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ভর্ৎসনা করেছিলেন, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন মনমোহনের মতো ব্যক্তি নিশ্চয়ই পদত্যাগ করবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেননি। ধারণা করা যায়, দুটি কারণে তিনি সেটা করেননি; যদিও সেই লক্ষ্যে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন। মনমোহন হয়তো শেষ মুহূর্তে ভেবেছিলেন, তিনি পদত্যাগ করলে সরকার এবং কংগ্রেস দলকে কঠিন সংকটের দিকেই ঠেলে দেওয়া হবে, যা তার হয়তো করাটা সমীচীন হবে না। কেননা কংগ্রেস দল ও বিশেষ করে দলনেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কারণেই তিনি ভারতের মতো বিশাল দেশের সরকারপ্রধান হতে পেরেছেন এবং বেশ কয়েক বছর ধরে সেই পদে আসীন আছেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একজন দক্ষ প্রশাসক ও সফল অর্থমন্ত্রী হলেও রাজনীতিতে তিনি তেমন কোনো 'ফ্যাক্টর' ছিলেন না। কংগ্রেস দলের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন না। মনমোহন সিং কখনও প্রত্যক্ষ নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি। বর্তমানেও তিনি যে পার্লামেন্ট সদস্য আছেন, সেটাও প্রত্যক্ষভাবে নয়, পরোক্ষভাবে নির্বাচিত রাজ্যসভার সদস্য। আবার সেটাও নিজ রাজ্য পাঞ্জাব নয়, অনেক দূরের আসাম রাজ্য থেকে তিনি কোটায় নির্বাচিত হয়েছেন। উল্লেখ্য, রাজ্যসভার অর্থাৎ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্যরা দেশের এমপি এবং বিধানসভার (রাজ্যের আইন পরিষদ) সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অন্যদিকে লোকসভা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত।
মনমোহন তাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য কংগ্রেস দল ও এর প্রধান সোনিয়া গান্ধীর কাছে দারুণভাবে ঋণী এবং সেটা তিনি প্রকাশ্যেই বলে থাকেন। সোনিয়া ২০০৪ সালে নিজে প্রধানমন্ত্রী না হয়ে ড. মনমোহনকে সেই পদের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। এ সিদ্ধান্তে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। তাই পদত্যাগ করে মনমোহন দল এবং নেত্রীর জন্য গভীরতর সমস্যা সৃষ্টি করতে চাননি। অতি সম্প্রতি যখন সুপ্রিম কোর্ট সেই টেলিফোন কেলেঙ্কারি দুর্নীতির মামলায় পূর্বে সরকার কর্তৃক ১২২টি লাইসেন্সকে বাতিল ঘোষণা করেন, তখন পুনরায় নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে মনমোহনের ওপর পদত্যাগের চাপ বৃদ্ধি হয়। তথাপি তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেননি। মনমোহন এমনিতেই কম কথা বলেন। মিতব্যয়ী প্রধানমন্ত্রী সহজে কোনো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মুখই খুলতে চান না। এই নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। একটি হলো, যখন মনমোহন কিছুতেই মুখ খুলছেন না, তখন বলা হলো 'দয়া করে প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলুন_ আমি আপনার ডেন্টিস্ট!'
তবে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি মুখ খুলেছেন ও বলেছেন, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি দেশকে শেষ করে ফেলেছে। এ অবস্থা থেকে ভারতকে রক্ষা করা কঠিন বৈকি। তার বক্তব্যে হতাশার সুর অত্যন্ত স্পষ্ট।
অন্যদিকে কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়াপুত্র এবং দেশের আগামীদিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনেকের কাছেই বিবেচিত রাহুল গান্ধীকে দেশের নেতা হিসেবে দেখার জন্য অনেক কংগ্রেস নেতাকর্মী অধীর হয়ে আছেন। তারা মনে করেন, দুর্নীতি এবং আরও অনেক সমস্যায় জর্জরিত বর্তমান কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ জোট সরকারকে সংকট থেকে তুলে আনার জন্য প্রয়োজন আকর্ষণীয় নেতৃত্ব। তারা মনে করেন, মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে রাজনৈতিক গতিশীলতা নেই এবং রাহুল গান্ধীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে সরকারে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তবে রাহুল নিজে এ ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তা সত্ত্বেও ধারণা বিদ্যমান যে, রাহুল বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সেই আসন অলঙ্কৃত করবেন।
তবে বর্তমানে উত্তর প্রদেশসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এসব রাজ্যের মধ্যে উত্তর প্রদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানে কংগ্রেস আগের গৌরব ফিরিয়ে আনতে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে, যদিও কাজটি কঠিন। এখানে নির্বাচনে কংগ্রেসের সফলতা-ব্যর্থতার সঙ্গে রাহুল প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং দেশে আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা জড়িত। কংগ্রেসের সঙ্গে মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসসহ ছোট এবং আঞ্চলিক দলের দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি এই দূরত্ব আরও বেড়ে যায়, তাহলে কংগ্রেসের জন্য ২০১২ সালটি সরকারে কাটানো কঠিন হতে পারে।

জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী : কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.