বর্ণাঢ্য জীবন থেকে না ফেরার দেশে by আনোয়ার হোসেন

সাংবাদিক অশোক সেন ছিলেন মৃদুভাষী, সদালাপী ও নিরহঙ্কার। মানুষটি ২০০৯ সালের ৩ জানুুয়ারি পরিবার ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাঁদিয়ে চলে গেছেন না-ফেরা দেশে। ১৯৫২ সালে যশোর জেলার কেশবপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পড়ালেখা করেছেন কেশবপুর হাইস্কুল ও যশোর এমএম কলেজে। স্কুলজীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন ভারতের বনগাঁর


টালীখোলায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ১৯৮০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সিপিবি যশোর জেলা শাখার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। ১৯৭৩ সালে যশোর উদীচী প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কর্মজীবনে অশোক সেন সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক ঠিকানা ও দৈনিক কল্যাণ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। দৈনিক ভোরের কাগজের যশোর জেলার প্রতিনিধি এবং প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত প্রথম আলোর সঙ্গেই ছিলেন। দীর্ঘ সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, একজন সফল সাংবাদিক হয়ে ওঠা কিন্তু যশোরেই। যশোর শহরের বেজপাড়া শ্রীধর পুকুর পাড়ের রেবা চন্দের স্নেহ ও ভালোবাসায় দীর্ঘ ৩৫ বছর ওই বাড়িতে একজন সদস্য হিসেবে অবস্থান করেছেন। সহধর্মিণী বেবী সেন ও একমাত্র সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্ণব সেন পান্থ তার পারিবারিক জীবনকে পূর্ণ করেছিল। তাছাড়া যশোরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের কৃতীজনরা তার কর্মময় জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন।
আমার সঙ্গে এক যুগের পরিচয়ে অশোক দাদার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে যাদের দেখেছি তারা হলেন_ ডা. কাজী রবিউল হক, অধ্যাপক আমিরুল আলম খান, এমআর খাইরুল উমাম, তারাপদ দাস, হাবিবা সেফা, কামরুজ্জামান চুন্নুু, একরাম-উদ-দ্দৌলা, মবিনুল ইসলাম মবিন, সাহা কিরণ কুমার কচি, তৌহিদুর রহমান, সাজেদ রহমান, রুকুনউদ্দৌলা, শাহদাত হোসেন কাবিল, এলাহ্দাদ খান, অশোক রায়, শ্রাবণী সুর, আজিজুল হক মনি, ব্যবসায়ী মতিউর রহমান, দেলোয়ার হোসেন খোকন, আনন্দ দাস, ফকরে আলম, জাহিদ হাসান টুকুন, সুন্দর সাহা, আনোয়ার হোসেন, মকবুল হোসেন, এঞ্জেলা গোমেজ, অধ্যাপিকা সুরাইয়া শরীফ, মাহবুবুর রহমান মজনু, আমিরুল ইসলাম রন্টু, তন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ। কর্মজীবনে অশোক সেন গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগ, কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা, মাদক ও এসিডবিরোধী আন্দোলন, ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি যেভাবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন তেমনি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, যশোর উন্নয়ন, ভবদহ জলাবদ্ধতা, নদী বাঁচাও আন্দোলন, উদীচীর বর্ষবরণ, উদীচীর জাতীয় সম্মেলন, রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন এবং সাংবাদিকদের অধিকার আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অশোক সেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দেওয়া কোনো সুযোগ-সুবিধা কখনও কোথাও থেকে গ্রহণ করেননি। মুুক্তিযোদ্ধার সনদ পর্যন্ত নেননি। মৃত্যুর পর তার সহযোদ্ধারা তাকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিয়ে দাহ করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মৃত্যুতে মুক্তিযোদ্ধা সম্বোধন করে শোকবার্তা দিয়েছেন। নির্লোভ ও নির্মোহ অশোক সেনের জীবনে চাওয়া-পাওয়া ছিল খুবই কম। অল্পতে সন্তুষ্ট থাকতেন তিনি। পরিবার-পরিজনের জন্য তেমন কিছুই রেখে যেতে পারেননি। অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিতে চাইলে তিনি তাতে সম্মতি দেননি। তার আদর্শ শুধু তার পরিবারের জন্য নয় বরং আমাদের মতো অনেক সুহৃদও ধারণ করবে আজীবন।

No comments

Powered by Blogger.