ভারতে উপাচার্য হওয়ার প্রস্তাব ছিল আইনস্টাইনের কাছে

ময়টা ১৯৩৭। ভারত তখনও স্বাধীন হয়নি। আর মানচিত্রেও ত্রিবাঙ্কুরকে সরিয়ে কেরালা নামটা জায়গা পায়নি। সেখানেই নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য দরকার পড়ল জাঁদরেল উপাচার্যের। এমন কেউ, যার শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, খ্যাতি হবে বিশ্বজোড়া। এমন একজন, যার উপস্থিতি ত্রিবাঙ্কুর বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা মাত্রা দেবে।

তাই উপাচার্য হওয়ার আমন্ত্রণ পাঠিয়ে চিঠি গেল কলম্বাসের দেশে। প্রেরক, ত্রিবাঙ্কুরের শেষ রাজা চিথিরা তিরুনল বলরাম বর্মা।

প্রাপক? অ্যালবার্ট আইনস্টাইন!

চমকপ্রদ এই তথ্যটা লুকিয়ে ছিল ইতিহাসের কোনও এক পাতায়। ধুলো ঝেড়ে সামনে এলো ত্রিবাঙ্কুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমানে যা কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়) ৭৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর লেখা প্রয়াত ইতিহাসবিদ এ শ্রীধর মেননের বই থেকে জানা গিয়েছে, ১৯৩৭ সালে ত্রিবাঙ্কুরের শেষ রাজা আইনস্টাইনকে নয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণপত্রে এও জানানো হয়েছিল, উপাচার্য হিসেবে মাসিক ৬০০০ টাকা পারিশ্রমিক পাবেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী!

এটাই একমাত্র চমক নয়। আরও অনেক কিছু লুকিয়ে ছিল ওই আমন্ত্রণের আড়ালে।

আইনস্টাইনের কাছে ত্রিবাঙ্কুরের রাজার নামে চিঠি গিয়েছিল ঠিকই। তবে গোটা বিষয়টির মূল মস্তিষ্ক ছিলেন অন্য এক জন। তিনি ত্রিবাঙ্কুরের তৎকালীন দেওয়ান, সিপি রামস্বামী আইয়ার। ইতিহাসবিদেরা জানাচ্ছেন, দক্ষ প্রশাসক হিসেবে সুপরিচিত রামস্বামীর আরও একটি পরিচয় ছিল। ইতিহাস থেকে আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর জ্ঞান ছিল অপরিসীম। তাই রাজা বলরাম ত্রিবাঙ্কুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা ভাবার পরেই রামস্বামী তাকে পরামর্শ দেন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে উপাচার্য তথা অধ্যাপক হিসেবে আনার চেষ্টা করা হোক। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান এবং উৎকর্ষকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
   
আইনস্টাইন রামস্বামী আইয়ার
আইনস্টাইন অবশ্য সাগর পেরিয়ে এ দেশে আসেননি। সবিনয়ে জানিয়েছিলেন, কিছু ‘ব্যক্তিগত কারণে’ তিনি আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে আগ্রহী। কিন্তু হয়তো মনে মনে কুর্নিশই করেছিলেন পরাধীন ভারতের কোনও এক অখ্যাত প্রদেশের শিক্ষাব্রতীদের স্বপ্ন দেখার সাহসকে।

সাহসই বটে। ইতিহাসবিদ সরোজা সুন্দররাজন জানাচ্ছেন, রামস্বামীর ভাবনায় কিছুই অসম্ভব ছিল না। তাই শুধুমাত্র আইনস্টাইন নয়, বিজ্ঞানী জুলিয়ান হাক্সলে, সি ভি রমন, মেঘনাদ সাহা থেকে শুরু করে সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণকেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। সেই প্রচেষ্টাও যদিও সফল হয়নি। শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পদে রামস্বামীকেই বসানো হয়। আর এক ইতিহাসবিদ এম জি শশিভূষণের আক্ষেপ, ‘সিপি রামস্বামী স্টেট কাউন্সিল-এর কাছে আইনস্টাইনকে আনার প্রস্তাব দেন, এ কথা বহু লোকের মুখে শুনেছি। তবে আইনস্টাইনকে যে চিঠিটা পাঠানো হয়েছিল, তার প্রতিলিপি এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

ইতিহাসবিদদের একাংশ আবার মনে করেন, আইনস্টাইনকে উপাচার্য হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাবের পেছনে ‘শিক্ষাব্রতী’ রামস্বামীর থেকেও বেশি ছিলেন ‘কূটনীতিক’ রামস্বামী। তিনি চেয়েছিলেন, ‘স্থানীয় প্রভাব’ কাজে লাগিয়ে এমন কেউ যেন উপাচার্য হওয়ার চেষ্টা না করেন, যিনি ওই পদে অনুপযুক্ত। তাছাড়া আইনস্টাইনের মতো নাম মনোনয়নের জন্য থাকলে ওই পদের গুরুত্ব সম্পর্কেও সবার একটা ধারণা থাকবে।

তবে এরপরও সবাই স্বীকার করেন, শিক্ষার প্রসারে রামস্বামীর ভূমিকা এবং তার সাহস অনস্বীকার্য। কারণ, আইনস্টাইনকে আনতে না-পারলেও ত্রিবাঙ্কুর বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের শিক্ষার মানচিত্রে জায়গা করে দিয়েছেন সিপি। সূত্র: আনন্দবাজার।

No comments

Powered by Blogger.