প্রচারের শেষ মুহূর্তে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ by সাবি্বর নেওয়াজ

প্রচারকার্য শেষ। গতকাল মধ্যরাত থেকে থেমে গেছে মাইকের আওয়াজ, গণসংযোগ, পথসভা ও উঠান বৈঠক। এমনকি টেলিভিশন টক শোতেও প্রার্থীদের অংশগ্রহণ আজ থেকে বন্ধ। এখন কেবল ভোটের লড়াইয়ের অপেক্ষা। বাকি আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা। ৫৩ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে প্রথম নগরপিতার সম্মান কার ললাটে জোটে_ তা দেখার অপেক্ষায় এখন কুমিল্লা নগরবাসী। প্রচারের শেষ মুহূর্তে টাকার ছড়াছড়ি শুরু হয়েছে বলে
অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে মূল অভিযোগ উঠেছে দুই তারকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে। এমনকি ভোটারদের কাছে টাকা বিতরণের সময় ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ছোটন (২৪) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টায় ওই ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃত ছোটন বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর পক্ষে টাকা বিতরণ করছিল। সাক্কু ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জানা গেছে, সালমানপুর মাস্টার বাড়ির হারুনের ছেলে ছোটন ৯৬ হাজার ৫০০
টাকা ভোটারদের মধ্যে বিলি করছিল। এর মধ্যে ৮৮ হাজার টাকা বিলি করা হয়েছে। বাকি ৮ হাজার ৫০০ টাকা তার কাছে ছিল। ওই টাকা এবং যাদের কাছে টাকা বিলি করা হয়েছে তাদের তালিকাসহ তাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ধরে ফেলে। পরে ওই স্থানে র‌্যাব, পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হন। ছোটনকে পরে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানায় নিয়ে আসা হয়। এ দিকে মনিরুল হক সাক্কু বলেন, ছোটন ছাত্রশিবিরের সঙ্গী। তার বাবা অ্যাডভোকেট আরিফুল হক। তিনি বলেন, তিনি ছোটনকে চেনেন না। ছোটন কার টাকা বিলি করেছে, তা তিনি জানেন না। জামায়াত নেতা রেজাউল করিম জানান, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের এমডিকে আরিফ বখশী জামায়াত সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী। ছোটন তার কর্মী। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সেতাফুল ইসলাম জানান, ছোটনকে দু'মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে।
এদিকে কুমিল্লার মুচিপট্টি, শুভপুর, চকবাজার, ছাতিপট্টি, সংরাইশ, হাড্ডিখোলা এলাকার বস্তিবাসী ও দরিদ্র মানুষের ভোট কেনার অভিযোগও মিলেছে। ভোট কেনার কৌশল হিসেবে ভোটারদের টাকা দিয়ে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে নিচ্ছেন প্রার্থীর সমর্থকরা। নির্বাচনের দিন কেন্দ্রে যাওয়ার পর তাদের হাতে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসার আবদুল বাতেন সমকালকে বলেন, ভোট কিনে ভোটারদের আইডি কার্ড রেখে দেওয়া হচ্ছে বলে শুনেছি, কিন্তু কোনো প্রমাণ পাইনি। তিনি জানান, আমরা অভিযোগটি পাওয়ার পর কড়া নজর রাখছি। ২৭টি ওয়ার্ডে ২৭ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং ৯ জন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে আছেন। তারা নির্বাচনের পরদিন পর্যন্ত মাঠে থাকবেন। প্রার্থী বা ভোটার বা প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক দ্বারা কোনো ধরনের আচরণবিধি লঙ্ঘন, প্রভাব সৃষ্টি, ভোটারদের মধ্যে কালো টাকা বিতরণ এসব দেখভাল করছেন ম্যাজিস্ট্রেটরা। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত, সন্ত্রাসপ্রবণ, বস্তি, গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের প্রভাবাধীন এবং প্রত্যন্ত এলাকায় কড়া নজরদারি রাখতে ম্যাজিস্ট্রেটদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার।
স্নায়ু চাপে দুই মেয়র প্রার্থী : সাধারণ ভোটারদের মতে, শেষ পর্যন্ত মেয়র পদে দ্বিমুখী লড়াই হতে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আনারস প্রতীকের অ্যাডভোকেট আফজল খান ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী হাঁস প্রতীকের মনিরুল হক সাক্কুর মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস মিলছে। নির্বাচনের মাঠে এই দুই হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থী এ মুহূর্তে রয়েছেন চরম স্নায়ু চাপে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রমতে, বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আফজল খান স্নায়ু চাপে আছেন নিজ দলের নেতাদের নিয়েই। দলের দুই বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী চশমা প্রতীকের নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম ও জাহাজ প্রতীকের অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু শেষ মুহূর্তে এসেও ভোটের মাঠ ত্যাগ না করায় আফজল খানের ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা অনেকটাই হতাশ। তারা এ জন্য জেলার সিনিয়র নেতা ও সাংসদদের দুষছেন। শুধু তাই নয়, কমপক্ষে তিনজন সাংসদকে নিয়ে আফজল ঘরানার নেতাকর্মীদের মনে রয়েছে গভীর সংশয়। যদিও এ তিনজন সাংসদই গত কয়েক দিনে আফজল খানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন। অন্যদিকে, আফজল খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হক সাক্কুর প্রধান মাথাব্যথা সরকারি দলের প্রার্থীর প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি নিয়ে। সাক্কুর নেতাকর্মীদের মতে, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে সরকারি দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করার অপচেষ্টা করা হতে পারে। এ ছাড়া জেলা বিএনপির একটি ক্ষুদ্র অংশও ভেতরে ভেতরে সাক্কুর বিরোধিতায় আছে বলে মনে করছেন তারা।
প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী নিজ নিজ ঘর সামাল দিতে পারলে আগামীকাল বৃহস্পতিবার 'আফজল-সাক্কু ভোটের লড়াই' জমজমাট হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন কুমিল্লার সাধারণ মানুষ। শহরের জিলা স্কুল সড়কের বাসিন্দা খন্দকার আবু আব্বাস সমকালকে বলেন, সাধারণ ভোটাররা এরই মধ্যে মনস্থ করে ফেলেছেন কাকে ভোট দেবেন। তাই সাধারণ ভোটারদের সমর্থন নতুন করে টানার আর কিছু নেই। যারা নিজ দলের নেতাকর্মীদের বেশির ভাগকে আস্থায় আনতে পারবেন, তারাই নির্বাচনে শেষ হাসি হাসবেন।
তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গ্রেফতার : এদিকে রাতে দ্বিতীয় মুরাদপুরের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী শহিদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শহিদ বিএনপি নেতা মাশুক কমিশনারের ছোট ভাই।
লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি :কুসিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দুই মেয়র প্রার্থী কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবেন না বলেই মনে করছেন কুমিল্লার নির্বাচনী বিশ্লেষকরা। সাবেক পৌর মেয়র সাক্কু গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু করেছেন তার প্রচার। গতকাল রাত ১২টায় তা শেষ করেন। তিনি চেষ্টা করেছেন সব ভোটারের কাছে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হতে। অন্যদিকে আফজল খান তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রচারে ব্যাপকভাবে উপস্থিত থাকতে না পারলেও তার পক্ষে প্রচারের কোনো কমতি ছিল না। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা, দলীয় সাংসদ, নেতাকর্মীরা তার পক্ষে প্রচারে অংশ নেন। আনারস আর হাঁস প্রতীকের এ লড়াইকে বহু গুণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে নির্বাচনে প্রথমবারের মতো শতভাগ ইভিএমের ব্যবহার।
নতুন বছরে নেত্রীর উপহার হবে কুসিক :সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ নাসিম কুমিল্লায় এসে বলেছেন, 'জননেত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লাবাসীকে একটি সিটি করপোরেশন উপহার দিয়েছেন। এটা তার সন্তানের মতো। নেত্রীর এ উপহার কুমিল্লাবাসীকে ধরে রাখতে হবে। কুমিল্লাবাসী যদি সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন, পরে সবাইকে কপাল চাপড়াতে হবে।'
নাসিম বলেন, 'আমাদের সরকার ক্ষমতায়, নেত্রীর নিজের উপহার এ সিটি করপোরেশন। তিনি কুমিল্লাকে সাজাতে অবশ্যই গুরুত্ব দেবেন। নেত্রীকে নতুন বছরের উপহার হিসেবে আপনাদের আনারস প্রতীককে বিজয়ী করতে হবে।'
ফেসবুকেও প্রচার :নির্বাচনের প্রার্থীরা সামাজিক যোগাযোগের সাইট 'ফেসবুক' ব্যবহার করে নিজেদের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। কুসিক নির্বাচনে ৯ জনের মধ্যে ৫ জন মেয়র প্রার্থীই ফেসবুকের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন। তারা হলেন_ অ্যাডভোকেট আফজল খান, মনিরুল হক সাক্কু, এয়ার আহমেদ সেলিম, নূর উর রহমান মাহমুদ তানিম এবং অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু।

No comments

Powered by Blogger.