নামমাত্র সম্মানীতেও উৎসে কর-রেডিও-টেলিভিশন by তুহিন ওয়াদুদ

জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধি করে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের শিল্পীদের সম্মানী যত তাড়াতাড়ি সম্মানজনক করা যায় জাতির জন্য ততই মঙ্গল বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রাণ হচ্ছেন এর শিল্পীরাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয়, তাদের কখনোই সম্মানজনক হারে সম্মানী প্রদান করা হয়নি। বর্তমান সরকার আবার মাত্রাতিরিক্ত হারে উৎসে কর


কাটতে শুরু করেছে। সরকার শিল্পীদের সম্মানীতে উৎসে কর কাটতেই পারে। উৎসে কর কাটা ভালোই। সরকার শিল্পীদের নামমাত্র সম্মানীতে ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটতেও শুরু করেছে। এ নিয়ে শিল্পীদের ক্ষোভের কোনো কারণ থাকত না যদি তাদের সম্মানজনক সম্মানী দেওয়া হতো। একটি গান যখন পূর্ণতা লাভ করে তখন সেই গানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন গানের গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রী এবং কণ্ঠশিল্পী। সময় হিসাব করে শিল্পীদের সম্মানী দেওয়া হলেও তার গানপ্রতি হার খুবই সামান্য। একজন সি গ্রেডের শিল্পী বছরে চারবার গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। তিনি দুটি গান গেয়ে পান মাত্র ২২০ টাকা। বি গ্রেডের একজন শিল্পী বছরে ছয়বার গান গাওয়ার সুযোগ পান। সম্মানী পান গানপ্রতি অনধিক ২০০ টাকা। একজন এ গ্রেডের শিল্পী প্রতি মাসে একবার গান গেয়ে গানপ্রতি সম্মানী পান অনধিক ২৫০ টাকা। বিশেষ গ্রেডের শিল্পী প্রতি মাসে একবার গান গেয়ে গানপ্রতি সম্মানী পান অনধিক ৩০০ টাকা। একজন শিশুশিল্পীর একটি অনুষ্ঠানের জন্য সম্মানী ১৪০ টাকা মাত্র। একজন গীতিকারের প্রতি গান বাজলে সম্মানী পান শুধুই ৩ টাকা, নাট্যশিল্পীদের সম্মানী ৩২৭ টাকা, একজন কথক পাঁচ মিনিট থেকে ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত সময়ের জন্য সম্মানী পান ৪৩২ টাকা। অনুষ্ঠানের ঘোষক, সংবাদ পাঠক, অনুবাদক, অনুলিপিকার, যন্ত্রীদের ক্ষেত্রেও ঘটনা একই রূপ। এই সামান্য টাকার ওপর যখন ১০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটা হয় তখন সেটাকে মূল্যায়নের ভাষা থাকে না। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সম্মানী কিছুটা বাড়িয়েছিল। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কিছুটা বাড়িয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিল্পীদের সম্মানী না বাড়িয়ে উৎসে কর কাটা শুরু করেছে।
বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আসীন করার লক্ষ্যে সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমান সরকারকে আমরা শিল্পবান্ধব সরকার বলেই জানতাম। কিন্তু বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে গণমাধ্যমের সম্প্র্রচার নীতিমালার ওপর যে আইন চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে বর্তমান সরকার গণমাধ্যমবিরোধী এবং শিল্পের শত্রুপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনের শিল্পীদের সম্মানী কিছুটা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেই বৃদ্ধিও সম্মানজনক হয়নি। বাংলাদেশের কোনো শিল্পী রাষ্ট্রীয় পরিচর্যায় সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন না। যাতে একজন শিল্পী সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন সে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনের দর্শক সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে দিন দিন যে হারে এই দর্শক সংখ্যা কমছে তাতে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিটিভির দর্শক সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নামতে চলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের বেতার ব্যবস্থা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ বেসরকারি বেতার ব্যবস্থা নতুন করে জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। এফএম রেডিও এমনকি কমিউনিটি রেডিও পর্যন্ত গণমুখী হচ্ছে।
জাতীয় স্বার্থে বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে প্রতিষ্ঠান দুটির অনুষ্ঠানের মান বৃদ্ধি করে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের শিল্পীদের সম্মানী যত তাড়াতাড়ি সম্মানজনক করা যায় জাতির জন্য ততই মঙ্গল। শিল্পীদের অবদান হয়তো অর্থপ্রাপ্তির মতো হাতে হাতে পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের চিত্তলোকের ক্ষুধা নিবারণে এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা নেই। শিল্পী শুধু দিনের পর দিন অন্তরের তাগিদ থেকে নিজের ক্ষতিসাধন করে হলেও গান পরিবেশন করে যাবেন, আর রাষ্ট্র তাদের জন্য কিছুই করবে না_ তা হতে পারে না। শিল্পীদের যথাযথ সম্মান প্রদানে আমরা বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রত্যাশা করি।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.