আবার বেসামাল ছাত্রলীগ by অমরেশ রায়

বারও বেসামাল ছাত্রলীগ। কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না সংগঠনের উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীদের। তাদের সন্ত্রাস-সহিংসতা ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলের জের ধরে বছরের শুরুতে আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ম্লান হয়ে পড়ছে ছাত্রলীগ নামের দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটির অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য। বিব্রত হতে হচ্ছে সরকারকেও।


অন্যদিকে খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার কড়া হুশিয়ারিতেও ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারক মহল ছাত্রলীগ কিংবা অন্য সংগঠনের পরিচয়কে প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস কঠোর হস্তে দমনের বারংবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলেও পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেনি। ছাত্রলীগের বেপরোয়া বেসামাল কর্মকাণ্ডের সর্বশেষ নজির দেখা গেছে মঙ্গলবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সংগঠনের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন
ফি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনরত প্রগতিশীল ছাত্রজোট নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়ে ৭ জনকে আহত ও দুই ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করেছে। এর আগের দিন সোমবার ছাত্রলীগের সহিংসতায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক ভোজে নিম্নমানের খাবারের প্রতিবাদ করলে আয়োজক কমিটির সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে ২৫ জনকে গুরুতর আহত করেছে।
একইদিন বিদায়ী ব্যাচের এক ছাত্রকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে আজীবন বহিষ্কৃত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রলীগ কর্মী সুজিত ও মিথুন। শনিবার পূর্ববিরোধের জের ধরে এরা পিটিয়েছিল ঈশান নামের এক ছাত্রকে।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নতুন বছরের সূচনা দিন রোববার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় ৫ জন আহত হয়। পুলিশ ১টি পিস্তল, অসংখ্য দেশীয় অস্ত্রসহ ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটকও করে। একইদিন রাতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হলে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয় ৪ জন। এছাড়া ইউজিসি চেয়ারম্যান ও উপাচার্যের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উত্তপ্ত হয়ে ওঠার পেছনেও ছাত্রলীগের একাংশের জোরালো ভূমিকা দেখা গেছে।
অবশ্য ছাত্রলীগের এ বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিজয়ের পর থেকেই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোতে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠন ক্ষেত্রবিশেষে নিজেদের মধ্যে সহিংসতা-গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি ভর্তিবাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির মতো নানা অপকর্মেও জড়িয়ে পড়ে তারা। ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনাও সারাদেশে নিন্দা কুড়িয়েছে। দেশজুড়ে ছাত্রলীগের এ সহিংসতায় তিন বছরে কমপক্ষে ৫ নেতাকর্মী নিজ সংগঠনের প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিকের নিহত হওয়ার ঘটনা সারাদেশে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল।
গতকাল মঙ্গলবার শিক্ষক সমিতি বৈঠক করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্যাম্পাসে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করাসহ বিভিন্ন দাবি তুলেছে। শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি ড. মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, ক্যাম্পাসের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতেই তারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করাসহ বিভিন্ন দাবি তুলেছেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটনাগুলোর ব্যাপারে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ মানতে রাজি নন সংগঠনটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ। তিনি বলেছেন, তাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তদন্ত করা হবে। তিনি বলেন, যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে তার দায় শুধু ছাত্রলীগের একার ওপর বর্তায় না। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি বা কার্যক্রম নেই, সেটার দায়দায়িত্ব তো আমরা নিতে পারি না। তিনি বলেন, খুলনা ও নোয়াখালী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ব্যাচের র‌্যাগ ডে উপলক্ষে তাদের মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে। সেখানে ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তিনি অভিযোগগুলোর ব্যাপারে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগ সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম উভয়েই কিছু উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীর কারণে গোটা সংগঠনের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ন হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। সমকালকে অভিন্ন ভাষায় তারা বলেন, যেসব জায়গায় সংগঠনের কমিটি নেই, সেসব জায়গাতেই ঝামেলা বেশি হচ্ছে। তবে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর চার দিনব্যাপী কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এ মুহূর্তে তারা সাংগঠনিক কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছেন না। কর্মসূচি শেষ হলে ৭ জানুয়ারির পর তারা দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি বিবদমান কমিটিগুলো ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করে দেবেন। এতে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে বলে তারা আশাবাদী।
বিবিসি জানায়, ছাত্রলীগ যখন আজ তাদের ৬৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে, সে সময় সংগঠনটিকে ঘিরে বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে অন্য কোনো পক্ষের উস্কানি থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। হানিফ বলেন, সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ এককভাবে দায়ী নয়। অন্যান্য ছাত্র সংগঠন এর জন্য বেশ দায়ী। আমরা লক্ষ্য করছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য অন্যান্য দল থেকে উস্কানি দেওয়া হয়। আমরা কখনও এসব ঘটনাকে প্রশ্রয় দেই না। হানিফ আরও বলেছেন, বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে তাতে তাদের বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.