‘শৈশবে অভিজ্ঞতালব্ধ পুরুষ হয় দ্বিগুণ নির্যাতনকারী’ by ইসমাইল হোসেন

শৈশবে মানসিক নির্যাতনের শিকার পুরুষরা নারী যৌনসঙ্গীকে দ্বিগুন নির্যাতন করে বলে একটি নতুন গবেষণায় তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এটি দেশের একটি নগর ও একটি গ্রামীণ এলাকার প্রতিনিধিত্বকারী প্রথম পরিসংখ্যানভিত্তিক গবেষণা বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশের গ্রাম এবং শহরের দুই হাজার ৪০০ পুরুষের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এই গবেষণা করা হয়েছে।

গেল বছরের শেষে আইসিডিডিআরবি ‘দ্যা চেইঞ্জ প্রজেক্ট: জেন্ডার, পৌরুষ এবং ক্ষমতা বোঝা ও জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন প্রতিরোধ’র অংশ হিসেবে গবেষণাকর্মটি পরিচালনা করে। ইউএনএফপিএ এবং পার্টনার্স ফর প্রিভেনশন সহায়তা করে।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, ‘শৈশবে মানসিক নির্যাতনের অভিজ্ঞতা আছে এমন পুরুষদের মধ্যে যৌনসঙ্গীকে নির্যাতন করার প্রবণতা দ্বিগুন। আর শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে এমন গ্রামীণ পুরুষদের মধ্যে যৌনসঙ্গীকে যৌনভাবে নির্যাতনের প্রবণতা দ্বিগুন হয়।’

নির্যাতনের এই চক্রকে ভাঙ্গতে প্রতিটি পরিবারকে শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ করে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর সমাজবিজ্ঞানীরা জোর দিয়েছেন ‘জীবন দক্ষতামূলক শিক্ষার ওপর।

জরিপের সামগ্রিক উদ্দেশ্য ছিল জেন্ডার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চাকে বোঝা।

সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষণাকর্মের ফলাফল থেকে জানা যায়, নারীর প্রতি পুরুষের নেতিবাচক মনোভাব নারী নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পরিবার টিকিয়ে রাখতে ৫৫ ভাগ নারী নির্যাতন সহ্য করে। অর্থাৎ নগরের অর্ধেক এবং গ্রামের ৬৫ ভাগ পুরুষ মনে করে নারীদের তার পরিবার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নির্যাতন সহ্য করে যাওয়া উচিত।

জরিপ থেকে জানা যায়, প্রায় সার্বজনীনভাবে পুরুষরা অন্তত একটি জেন্ডার বৈষম্যমূলক বক্তব্যের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। আর শতকরা ২০-২৯ ভাগ পুরুষ বেশ কয়েকটি জেন্ডার বৈষম্যমূলক বক্তব্যের পক্ষে রায় দেন। জেন্ডার বৈষম্যমূলক মনোভাব পোষণকারী পুরুষদের মধ্যে নারী যৌনসঙ্গীকে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন করার সম্ভাবনা কয়েকগুন বেশি।

গবেষণার তথ্যমতে, ৬০ শতাংশের অধিক পুরুষ মনে করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর মার খাওয়া দরকার। নগরের ৫০ ভাগ এবং গ্রামীণ পুরুষদের বেশীরভাগই (৬৫%) বিশ্বাস করে, নারীদের তার পরিবারকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নির্যাতন সহ্য করে যাওয়া উচিৎ। নগরের প্রায় ৭৮ ভাগ এবং ৯২ ভাগ গ্রামের পুরুষ বিশ্বাস করে, নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পরিবারের জন্য রান্না-বান্না করা এবং সংসার দেখাশোনা করা।

গবেষণায় আরো দেখা যায়, গ্রাম ও শহরে প্রায় ৫২ ভাগ পুরুষ তাদের নারী যৌনসঙ্গীকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন। যে পুরুষরা নারীদের উপর যৌন নির্যাতন করেছেন তাদের প্রায় ৮০ ভাগ নারীর উপর তাদের অবারিত যৌন অধিকারের বশবর্তী হয়ে এই কাজ করেছেন। মাত্র ১০ ভাগের কম যৌন নির্যাতনকারী পুরুষ নির্যাতনের পর আইনী পক্রিয়ার সম্মুখীন হবার ভয় পেয়েছেন।

গবেষণাকর্মটিতে অর্থায়ন করেছে ইএনএফপিএ। ‘পার্টনার্স ফর প্রিভেনশন: ওয়ার্কিং টু প্রিভেন্ট জেন্ডার বেইজড ভায়েলেন্স’ শীর্ষক প্রকল্পটি এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য ইউএনডিপি, ইউএনএফপিএ, ইউএন উইমেন এবং ইউএনভি এর একটি আঞ্চলিক প্রোগাম।

আইসিডিডিআরবি’র গবেষক ড. রুচিরা তাবাস্সুম নভেদ্ বলেন, এসব তথ্য প্রমাণ করে পুরষের জেন্ডার সংশ্লিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বিষেশভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ আর্থার আরকেনের মতে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং নির্যাতন প্রত্যাখানকারী পুরুষ এবং জেন্ডার সমতায় বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলায় আমাদের ব্যক্তিক, নীতিগত ও কার্যক্রমভিত্তিক প্রয়াস প্রয়োজন।

ড. রুচিরা বলেন, শৈশবে নির্যাতিত হবার অভিজ্ঞতা পুরুষদের পরবর্তী জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং তাদের নির্যাতনকারীতে রূপান্তরে সহায়তা করে।

তিনি বলেন, নির্যাতনের এই চক্রকে ভাঙ্গতে হলে আমাদের প্রতিটি পরিবারকে শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ করে তুলতে হবে। সকল শিশুর জন্য আত্মবিশ্বাসী, সুখী, ইতিবাচক, শান্তিকামী ব্যক্তি হিসাবে গড়ে উঠার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে; যেন তারা তাদের পরিবার ও দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখার প্রকৃত সুযোগ পায়।

শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার ব্যাপারে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা রয়েছে বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ।

তিনি বলেন, সুন্দরভাবে যাতে শিশুরা বেড়ে উঠতে পারে সেজন্য পরিবারকে হতে হবে শান্তিপূর্ণ। এছাড়া তিনি পাঠ্য পুস্তকে জীবন দক্ষতামূলক শিক্ষা অর্ন্তভূক্তকরণ, জাতীয়ভাবে নির্যাতনবিরোধী প্রচারণা চালানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

সমাজবিজ্ঞানী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. মিজানউদ্দিন বলেন, শিশুর সামাজিকীকরণ ও মনোজগত তৈরি হয়ে থাকে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। পরিবার থেকে যা শেখে পরিণত বয়সে তা প্রয়োগ করে থাকে। সে কারণে পরিবারকে কোলাহলমুক্ত এবং নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে।

No comments

Powered by Blogger.