বিশ্লেষণ-রাজনৈতিক অদূরদর্শিতায় বৈশ্বিক অর্থনীতি হুমকিতে

দূরদর্শী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। ফলে গত ত্রিশের দশকের মতো আরেকটি ভয়াবহ মন্দা বিশ্বে কড়া নাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমা দেশগুলোতে চলতি অর্থনৈতিক সংকটের রেশ ২০১২ সালের পরও থাকতে পারে। সেটা হলে সেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে। চার বছর আগে শুরু হওয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট এখন


যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। নেতারা দেশের ঋণের বোঝা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় আনতে ব্যর্থ হয়েছেন; পারেননি প্রবৃদ্ধির ভিতকে মজবুত করতে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। বাড়তি চাপ সহ্য করতে না পেরে সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে জনসাধারণ।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অস্থিরতা বিশ্ব অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের লাগাম উন্নয়নশীল বিশ্বের হাতে তুলে দেওয়াকে ত্বরান্বিত করেছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে চীন। পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে গেলে দ্বিতীয় বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হবে; ঘটবে রাজনৈতিক উত্থান, যেটা গত শতকের ত্রিশের দশকের পর আর দেখা যায়নি।
গত বছরে কয়েকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর নেতৃস্থানীয় রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদেরা এখন এমনটাই ভাবছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে: যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হ্রাস ও উন্নয়নশীল বিশ্বের বৃদ্ধি, ঋণের জন্য চীনের কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ধরনা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতায় ব্রাজিল যুক্তরাজ্যের সমকক্ষে পৌঁছানো।
বিশ্ব অর্থনীতির চাবিকাঠি উন্নয়নশীল বিশ্বের দিকে ধাবিত হওয়া নতুন কিছু নয়। তবে বর্তমানে এটা প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত গতিতে হচ্ছে। তাই বিশ্লেষকেরা বলছেন, পশ্চিমা গণতন্ত্র সংকটে পড়েছে। তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সরকার জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সেখানে বিত্তশালী ব্যক্তিদের কাছে রাজনীতিকদের হাত বাঁধা। এ কারণেই সেখানে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে, যার নেতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে এখনো। জনগণের মাথাপিছু ঋণের বোঝা বেড়েছে, উচ্চ হারে করের বোঝা চাপানো হয়েছে, বেকারত্ব বেড়েছে এবং ব্যয়সংকোচনের নামে সরকারি কর্মী ছাঁটাই করা হচ্ছে।
পক্ষান্তরে, উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের প্রতিষ্ঠান ও বাজারকে আধুনিকায়ন করছে, ফলে গত এক দশকে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তিন গুণ বেড়েছে।
লন্ডনের সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, জাতীয় প্রবৃদ্ধির দিক দিয়ে ২০২০ সালের মধ্যে চীন ও ব্রাজিলের মতো বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে ভারত ও রাশিয়ার আবির্ভাব ঘটবে। এ সময় বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির জোট জি-৭ থেকে ছিটকে পড়তে পারে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।
অর্থনীতিবিষয়ক ঐতিহাসিক নিয়াল ফার্গুসন এটাকে ক্ষমতার ঐতিহাসিক হাতবদল হিসেবে দেখছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা হারানোর বিষয়টি গভীর সমস্যার ইঙ্গিত। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রে টি-পার্টি আন্দোলন, ইউরোপে ওয়াল স্ট্রিট দখল করো আন্দোলন—এই আস্থাহীনতারই বহিঃপ্রকাশ।
ইউরোপবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিদার কুনলের মতে, যথাযথ নির্দেশনা ও নেতৃত্ব ছাড়া সঠিক পথ বেছে নেওয়ার প্রশ্নে অধীন ব্যক্তিরা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা তেমনই। সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রে সে রকম পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না, তা বোঝা না গেলেও ইউরোপের অবস্থা খুব শিগগির সেদিকে পৌঁছে যেতে পারে। রয়টার্স।

No comments

Powered by Blogger.