নিত্যজাতম্-ইতিহাস থেকে একটু শিক্ষা নিন by মহসীন হাবিব

গত ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপি-জামায়াতের ডাকা হরতালের পরদিন একাধিক পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছে। ছবিতে দেখা যায়, একজন পুলিশ সদস্য এক পিকেটারেরবুকেরওপরপাদিয়েচেপেধরেছেন।সংবাদপত্রওয়ালাদের তো আর এ নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই। তাঁরা শুধু নির্লিপ্তভাবে সংবাদের স্বার্থে এ ছবি ছেপে দিয়েছেন।


কিন্তু ছবিটি এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, যেন বাংলাদেশে পুলিশের বুটের নিচে গণতন্ত্র দলিত। হয়তো অনেকেই আশা করছেন, এ ছবি যেন কূটনৈতিক ব্যাগে করে চলে যায় নানা মহলে। এ ছবি চোখের সামনে তুলে ধরে কেউ কেউ বাংলাদেশে মানবতা কিভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেটা বোঝানোর চেষ্টা করবেন মাতব্বরগোছের দেশগুলোকে। আমি সেটাকে খুব দোষের বলে মনে করছি না। যে দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা অনেকটা নিজের এক চোখ কানা করে প্রতিবেশীর দুই চোখ কানা করে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা করার মতো, যে দেশের রাজনীতিবিদরা বিচার-সালিস নিয়ে প্রায় ১০ হাজার মাইল দূরে তিন লাখ টাকা দামের টিকিট কেটে ছোটাছুটি করেন, সে দেশে এই ছবিকে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার কাজে ব্যবহার করা হবে_এটা তো খুবই স্বাভাবিক একটি রাজনৈতিক ইচ্ছা।
২৪ সেপ্টেম্বর বিপুল ভোটে বিজয়ী এক সংসদ সদস্যের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম একটি রেস্তোরাঁয়। সেখানে ঢাকার একাধিক পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। এই ছবির আলোচনা উঠতে ওই সংসদ সদস্য বললেন, 'এটি অতি-উৎসাহী কোনো পুলিশ সদস্যের কাজ হতে পারে।'
তাঁর কথা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি। তবে এই 'অতি-উৎসাহী' শব্দ ব্যবহারে একটি জটিলতা আছে। অতি-উৎসাহীরা দুই ধরনের হতে পারেন। একটি হলো সরকারের প্রতি অতিমাত্রায় ভক্ত, যাঁরা শক্তি প্রয়োগ করে ভিন্নমতকে দমন করতে চান এবং সরকারের উপরমহলকে খুশি করে থাকেন; অন্যটি হলো সরকারের প্রশাসনে থেকে আনুগত্যের ভান করে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক শক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার একটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতে পারেন।
তৃতীয় আরেকটি শ্রেণী থাকতে পারে, যেটি সবচেয়ে ভয়ানক। সরকার একটি নীতি ও আদর্শ নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই শ্রেণী সরকারের ক্ষমতার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে ইতিহাসের একটি উদাহরণই যথাযথ_
সম্রাট হুমায়ুন যখন ভারতে প্রত্যাবর্তনের সময় আফগানিস্তানে এসে পেঁৗছেন, তখন বৈরাম খাঁ খানখানানের ভৃত্য হিসেবে পরিচিত হুসেন খাঁ হুমায়ুনের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। হুমায়ুনের কান্দাহার বিজয়ের সময় হুসেন খাঁ অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই সূত্রে হুমায়ুনের কাছে তিনি পার্মানেন্ট হয়ে যান। সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর মহামতি আকবর সিংহাসন লাভ করেন। তখনো উত্তরাধিকারসূত্রে হুসেন খাঁ মহামতি আকবরের সানি্নধ্য লাভ করেন। একসময় পাঞ্জাবে সিকান্দার শুরের সঙ্গে মোগলদের তীব্র লড়াই হয়। মানকোটের দুর্গ ঘিরে ভয়ানক যুদ্ধে হুসেন খাঁর ভাই হাসান খাঁ নিহত হন। হুসেন খাঁও বীরত্ব প্রদর্শন করলে সম্রাট আকবর তাঁর প্রতি আরো সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন। যা হোক, এই হুসেন খাঁ ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া ও অন্ধ ধার্মিক, যেটা প্রাথমিক পর্যায়ে আকবরের গোচরীভূত হয়নি। এতটা ধর্মান্ধ একজন মানুষ দিন-ই-ইলাহির প্রবক্তা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আকবরের দরবারে কী করে দীর্ঘদিন টিকে ছিলেন, সেটি একটি আলোচনার বিষয়। তখনকার দিনে মুসলমান শাসকদের দেখাদেখি হিন্দুদের মধ্যেও কিছু লোক লম্বা দাড়ি রাখতে পছন্দ করতেন। একসময় হুসেন খাঁ লাহোরের হাকিম নিযুক্ত হন। একদিন লম্বা দাড়িওয়ালা এক লোক হাকিমের দরবারে এলেন। হুসেন খাঁ ভক্তির সঙ্গে তাঁকে গ্রহণ করে সম্মান দেখালেন। একটু পরই তিনি জানতে পারলেন যে দাড়িওয়ালা এই মানুষটি হিন্দু। হুসেন খাঁ রেগে গিয়ে আদেশ দিলেন, এখন থেকে প্রত্যেক হিন্দু কাঁধে এক টুকরো রঙিন কাপড় আটকে রাখবে। আদেশপ্রাপ্তির পর লাহোরের সব হিন্দু কাঁধের ওপর রঙিন এক টুকরো কাপড় বেঁধে রাখতে থাকলেন। তখন থেকে হুসেন খাঁ পরিচিত হলেন হুসেন খাঁ টুকড়িয়া হিসেবে। এই টুকড়িয়া নামেই ইতিহাসে তিনি পরিচিত।
টুকড়িয়া হিন্দু মন্দির ও নিদর্শন ভাঙার কারণে ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন। আকবরের মতো অসাধারণ উদার ও অসাম্প্রদায়িক একজন সম্রাটের অধীনে থেকেও তিনি বিস্তৃত ভারতবর্ষের যত মন্দির ও দেব-দেবীর নিদর্শন ধ্বংস করেছেন, তা ইতিহাসে আর কেউ করেছে কি না সন্দেহ। অসংখ্য মন্দির ধ্বংস করে তিনি ধনরত্ন লুটে নিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর শত বছর পরও হিন্দুরা সেই সব ভাঙা মূর্তি, মন্দিরের টুকরো সংগ্রহ করে বেড়াতেন। এখনো নানা এলাকার মাটির নিচে ধ্বংসপ্রাপ্ত মূর্তি পাওয়া যায়। শক্তিশালী আকবরের অনুগত একজন মানুষ কিভাবে তাঁর অধীনে তাঁরই নীতির সম্পূর্ণ উল্টো আচরণ করেছেন, সেটাই লক্ষণীয়।
টুকড়িয়াকে লক্ষ্নৌয়ের জায়গির দেওয়া হয়েছিল সম্রাটের পক্ষ থেকে। একসময় টুকড়িয়ার শ্বশুর সর্দার মেহেন্দি কাশেম খাঁ হজ থেকে ফিরলেন (হুমায়ুন বেঁচে থাকতেই হুসেন খাঁকে আদর করে প্রিয় পাঠান সর্দার মেহেন্দি কাশেম খাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করিয়েছিলেন)। ফিরে আসার পর সম্রাট আকবর লক্ষ্নৌয়ের জায়গির হুসেন খাঁর কাছ থেকে নিয়ে তাঁর শ্বশুর মেহেন্দি কাশেমকে দিলেন। হুসেন খাঁ এটা পছন্দ করলেন না এবং শশুরের ওপর প্রতিশোধ নিতে স্ত্রীকে খয়রাবাদে (সীতাপুর) পাঠিয়ে দিয়ে নিজের চাচাতো বোনকে বিয়ে করলেন।
একদিকে হুসেন খাঁ টুকড়িয়া হিন্দু প্রজাদের ওপর ভয়ানক অত্যাচার করেন, অন্যদিকে বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিলে ভয়ানক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সুতরাং মহামতি আকবর তাঁকে নিয়ে প্রথম অবস্থায় ছিলেন দ্বিধান্বিত। ১৫৭৪ সালে ভোজপুরে (যেখান থেকে একসময় শেরশাহর উত্থান হয়েছিল) বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে আকবর সেখানে বিশৃঙ্খলা দমনের চেষ্টা করেন। এ সময় খোঁজ নিয়ে তিনি টুকড়িয়ার অত্যাচারের কথা জানতে পারেন। আকবর ভয়ানক অসন্তুষ্ট হন। দিলি্লতে সম্রাটের সঙ্গে টুকড়িয়া দেখা করতে গেলে তিনি হুসেন খাঁর সঙ্গে দেখা না করে তাঁকে দরবার থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। মহামতি আকবর বিমুখ হওয়ায় হুসেন খাঁ ভিন্ন পথ অবলম্বন করলেন। তিনি সব কিছু ছেড়ে দিয়ে গলায় কাফন জড়িয়ে ফকিরের বেশ ধরলেন। বললেন, 'এখন থেকে যে মহামতি হুমায়ুন আমাকে ভৃত্য রেখেছিলেন, আমি তাঁরই কবর ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করে বেঁচে থাকব।'
পিতার ব্যাপারে সম্রাট আকবর ছিলেন খুবই কাতর। টুকড়িয়ার ওপর সম্রাটের আবারও দয়া হলো। তিনি টুকড়িয়াকে কাঁটাগোলা ও পাটিয়ালির এক কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের জায়গির দান করলেন আবার। টুকড়িয়াও আবার সোনা-রুপায় সমৃদ্ধ মন্দিরগুলো লুট করতে শুরু করলেন। জমিদার-মহাজনরা দরবারে গিয়ে এ ব্যাপারে নালিশ জানালেন। এবার বাদশাহ আকবর খেপে গিয়ে একজন সেনাপতিসহ বিশাল সেনাবাহিনী পাঠালেন টুকড়িয়ার বিরুদ্ধে। টুকড়িয়া খবর পেয়ে বাংলার দিকে পালালেন। তাঁর আশা, বাংলায় গিয়ে পুরনো বন্ধু সাদিক মোহাম্মদ মুনায়েম খাঁকে দিয়ে বাদশাহর কাছে সুপারিশ করাবেন। কিন্তু বারা নামক স্থানে তিনি ধরা পড়ে গেলেন।
শুধু ইতিহাস থেকে টুকড়িয়ার কাহিনীর শিক্ষাটি নিলেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যেত। আমরা অভিভূত হয়ে লক্ষ করেছি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগত থেকে, স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেও পরবর্তী জীবনে বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত দেশপ্রেমের পথ থেকে সরে গিয়ে কেউ কেউ দুর্নীতি ও অপরাধকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের পরিচয় দানকারী ওই সব মানুষের ব্যাপারে কতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারেন প্রধানমন্ত্রী, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। শুধু ওই অতি-উৎসাহী পুলিশের কাণ্ডটি দেখা গেছে রাস্তায়। কিন্তু প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে, ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে এমন অনেক উৎসাহী ঢুকে পড়েছেন, যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। দেশের প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে আওয়ামী লীগের লোক হিসেবে বৈষম্য সৃষ্টি করছেন যাঁরা, তাঁরা কতটা ভালো ফল বয়ে আনছেন প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের জন্য? জেলায় জেলায় আদর্শে বিশ্বাস রাখেননি এমন লোক শুধু ঢুকেই পড়ছেন না, তাঁরা রীতিমতো ক্ষমতার অপব্যবহার করে চলেছেন। একটু খোঁজ নিলেই প্রধানমন্ত্রী জানতে পারবেন, জেলায় জেলায় আাওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসা জনতা ক্ষোভের সঙ্গে গুনগুন করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জানা অত্যন্ত জরুরি, এই টুকড়িয়াদের কর্মকাণ্ড, অভিপ্রায়_সব আওয়ামী লীগ সরকারের নামে রেকর্ড হচ্ছে, অথচ আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শের সঙ্গে এই মানুষদের তৎপরতা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে আরেকটি শ্রেণীর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও মহামতি আকবরের মতো নির্লিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রশ্নে কন্যা শেখ হাসিনাই শুধু নন, দেশপ্রেমিক জনগণও খুবই কাতর। কিন্তু একটি শ্রেণী বঙ্গবন্ধুর কথা বলে, আওয়ামী লীগে তাদের আত্মত্যাগকে বিক্রি করে জনগণের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পার কোনো সুযোগ আছে কি?

লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.