নানা নামে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে আত্মসাৎ

টেস্ট রিলিফ (টিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও টাকা (কাবিখা-কাবিটা) কর্মসূচিকে ঘিরে ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থক এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রাতারাতি গড়ে তুলছেন নানা নামের সংঘ, সমিতি ও ক্লাব। আর এর মাধ্যমেই আত্মসাৎ করা হচ্ছে বরাদ্দ করা অর্থ ও খাদ্যশস্য। এমনকি অস্তিত্বহীন মসজিদ, মন্দির ও গির্জার নামেও বরাদ্দ তুলে আত্মসাতের ঘটনা রয়েছে।


অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) চাপ দিয়ে এসব প্রকল্পের অর্থ ও খাদ্যশস্য ভুয়া বিল ও ভাউচার দিয়ে ছাড় করিয়ে নেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ পরিপত্র অনুসরণ করা হয় না।
ঝালকাঠি: ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ঝালকাঠি জেলায় টিআরের আওতায় এক হাজার ৭১৭টি প্রকল্পে এক কোটি দুই লাখ ৩৩ হাজার টাকা ও এক হাজার ৮৮৭ টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঝালকাঠি পৌর এলাকার বাহের রোডে জননী ক্লাব ও পাঠাগারের নামে এক টন গম উত্তোলন করা হলেও এ নামে কোনো সংগঠন খুঁজে পাওয়া যায়নি। জেলার কোথাও ব্লাড ব্যাংক না থাকলেও আইডিয়াল ব্লাড ব্যাংকের নামে তোলা হয়েছে এক টন গম।
ঝালকাঠি শহরের আদর্শ ক্লাব ও পাঠাগার, ইউনিক ক্লাব, ছলিম উদ্দিন মিয়া স্মৃতি সংসদ, বঙ্গবন্ধু ক্রীড়া চক্র, আবদুর রাজ্জাক হাফিজিয়া মাদ্রাসা, যুব সমাজকল্যাণ সংস্থা, ছাত্র কল্যাণ পরিষদের নামে এক টন করে গম ও ২১ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হলেও এসব সংগঠনেরও কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পূর্ব চাঁদকাঠি একতা যুবসংঘ ও পাঠাগারের সভাপতি রবিউল হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি শুনেছি, তবে এ ব্যাপারে কিছু বলে আমি ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’
ঝালকাঠি সদর উপজেলা গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ কমিটির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ রাজ্জাক আলী বলেন, সরকার বরাদ্দ দিয়ে ৮-১০ দিনের মধ্যে তালিকা জমা দিতে বলে। এই অল্প সময়ের মধ্যে তালিকা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয় না। তাই কিছু কাগুজে সংগঠনের নামে বরাদ্দ হয়ে যায়।
মেহেরপুর: মেহেরপুর থিয়েটার, মুক্তিযোদ্ধা একতা ক্লাব, অরণী থিয়েটার, জাগ্রত তরুণ সংঘ, এলাহীদাদ ফাউন্ডেশনের নামে প্রকল্প দেখিয়ে খাদ্যশস্য ও অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। বাস্তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। সদর উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রুমানা আহমেদ ভাষানী স্মৃতি সংসদের নামে এক টন চাল নিয়েছেন। এই প্রকল্পের চেয়ারম্যান তাঁর স্বামী শেখ সাঈদ আহমেদ। এই নামেও কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
মেহেরপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেন, মোট বরাদ্দের শতকরা ৭৫ ভাগই সাংসদ নিয়ে নেন। এসব প্রকল্পের ৮০ ভাগই ভুয়া।
মেহেরপুর-১ (সদর) আসনের সাংসদ জয়নাল আবেদীন জানান, তাঁর সুপারিশে প্রকল্প তৈরি হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলো কি না তা দেখেন পিআইও। সেক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতি হয়ে থাকলে পিআইও জানেন। সদর উপজেলার পিআইও নাহিদা সুলতানা বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। প্রকল্প সম্পর্কে কিছুই জানি না। তা ছাড়া এগুলো কীভাবে হয়, তা সবই আপনাদের জানা।’
সাতক্ষীরা: সদর উপজেলা ঝাউডাঙ্গা ইউপির পাথরঘাটা পাঠাগারের নামে বরাদ্দ দেওয়া দুই টন গম উত্তোলন করেছেন মহিবুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তবে ওই এলাকায় কোনো পাঠাগারের অস্তিত্বই মেলেনি। ওই এলাকায় কোনো পাঠাগারই নেই।
বল্লী ইউপির ঘরচালা পল্লী উন্নয়ন সমিতি সংস্কারের জন্য সাংসদ এম এ জব্বার ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। বরাদ্দ তুলেছেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবিদুর রহমান। এলাকায় গিয়ে একটি গুদামঘরের মধ্যে সাইনবোর্ড পাওয়া গেলেও ওই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ও কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। মুঠোফোনে আবিদুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে তাঁদের কোনো ঘর নেই। তবে খরচের হিসাব রয়েছে তাঁদের কাছে।’
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পিআইও জালাল উদ্দিন বলেন, ‘প্রকল্প শেষ হয়ে গেলে কাগজপত্র গুদামে চলে যায়। এসব বিষয় জানতে গেলে দেরি হবে।’
জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সাতক্ষীরা সদরের সাংসদ আবদুল জব্বার জানান, তিনি প্রকল্প বাছাই করেন। কিন্তু দেখার দায়িত্ব প্রকল্প কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। কাজ না হলে কিংবা অস্তিত্ব না থাকলে দায়দায়িত্ব তাঁদের।
পঞ্চগড়: পঞ্চগড় মহিলা ক্লাব উন্নয়নের জন্য দেড় লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প চেয়ারম্যান জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিয়া খাতুন টাকা তুলে নিয়েছেন। কিন্তু জেলা শহরের কোথাও এই ক্লাবের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। জাকিয়া খাতুনের দাবি, ক্লাব আছে, ইটের অভাবে কাজ করা হয়নি।
পঞ্চগড় ইউনিয়ন কৃষি ক্লাবের উন্নয়নের জন্য এক লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন প্রকল্পের চেয়ারম্যান মো. তৌহিদুল ইসলাম। এই কৃষি ক্লাব ও তৌহিদুল ইসলামের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া আটোয়ারী উপজেলার আলোয়াখোয়া ও বলরামপুর ইউনিয়ন কৃষি ক্লাব উন্নয়নের নামে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. খাদেমুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. মোজাক্কারুল আলম চৌধুরীর নামে এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এলাকায় এসব সংগঠনের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সদর উপজেলার চাকলাহাট ইউনিয়নের মুন্সীপাড়া সমবায় সমিতি, চাকলাহাট কুলি সমিতি, শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ, পরস্পর উন্নয়ন সংস্থা, শ্রমিক কল্যাণ সমিতি, মীরগড় কল্যাণ সমিতি, শ্রমজীবী নারী কল্যাণ সমিতির উন্নয়নের জন্য টিআরের আওতায় ২৫ হাজার টাকা করে এবং গরিনাবাড়ী ইউনিয়নের অঙ্গীকার সমাজ উন্নয়ন মহিলা সমিতি, তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষক ক্লাবের নামে ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আটোয়ারী উন্নয়ন পরিষদ পেয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। এলাকায় গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সবুজ কুমার গুপ্ত বলেন, সময়ের অভাবে অনেক প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শন না করেই বিল ভাউচার দেখে অর্থ বা খাদ্যশস্য ছাড় দিতে হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও: কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় মার্চ মাসে সদর উপজেলার আখানগর ইউনিয়নের চাপড়াপাড়া বাঁধ পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয় দেড় লাখ টাকা। চাপড়াপাড়ায় কোনো বাঁধ নেই। গ্রামের পল্লী চিকিৎসক জনাস রায় বলেন, গ্রামের আশপাশে যেখানে কোনো নদীই নেই, সেখানে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প দেখানোর অর্থ বরাদ্দ লুটেপুটে খাওয়া।
সদর উপজেলা পিআইও মো. ইউনুস আলী বলেন, ‘সংসদ সদস্যের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সব প্রকল্পের কাজ দেখতে সময়ের অভাবে যেতে পারিনি।’ স্থানীয় সাংসদ ও পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, শতভাগ যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয় না। তবে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।
সিরাজগঞ্জ: কাজিপুর উপজেলার চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নে শহীদ এম মনসুর আলী স্মৃতি পাঠাগার সংস্কারে কাবিখা প্রকল্পের ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সরেজমিনে এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রকল্পের সভাপতি ইউনিয়ন যুবলীগের নেতা মো. শফিকুল ইসলাম দাবি করেন, ক্লাবের কিছু সংস্কার করা হয়েছে।
পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও): জনগাঁও আবাসন গির্জা ও মন্দির সংস্কার নামের একটি প্রকল্পে টিআরের ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হলেও ওই নামে কোনো গির্জা ও মন্দির পাওয়া যায়নি। প্রকল্পের চেয়ারম্যান জয়দেব মুরমু বলেন, ‘উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পারুল বেগমের স্বামী গোলাম মোস্তফা আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটি প্রকল্প কমিটি বানিয়ে নিয়েছেন।’ ভাইস চেয়ারম্যান পারুল বেগম বলেন, ‘আমি তো শুনেছি কাজ হয়েছে। ঠিক আছে, আমি তাদের আবার জিজ্ঞাসা করব কেন তারা কাজ করেনি।’ তাঁর স্বামী মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘প্রকল্প আনতে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এ কারণে কম টাকা পরিশোধ করেছি।’
পীরগঞ্জের পিআইও রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি, মাঠ পর্যায়ে কাজ বুঝে নিতে সময় লাগবে। তবে অভিযোগ দিলে বা পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দুপচাঁচিয়া (বগুড়া): উপজেলার গোবিন্দপুর সাহারপুকুর পূজামণ্ডপের সংস্কারের নামে এক টন গম ও ইসলামপুর নবাবিয়া এতিমখানার নামে এক টন গম বরাদ্দ দেওয়া হলেও ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পিআইও কামরুল হাসান বলেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে বরাদ্দ আসায় তড়িঘড়ি করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে প্রকল্পের চেয়ারম্যানদের ডেকে কাজ করার কথা বলা হয়েছে। কাজ না করলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন আক্কাস সিকদার, ঝালকাঠি, তুহিন আরন্য, মেহেরপুর, কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা, শহীদুল ইসলাম, পঞ্চগড়, কাজী নুরুল ইসলাম, পীরগঞ্জ (ঠাকুরগাঁও), রমেশ কুমার, নান্দাইল (ময়মনসিংহ) ও আনিসুল ইসলাম, দুপচাঁচিয়া (বগুড়া)]

No comments

Powered by Blogger.