উৎসব-কাত্যায়নী পূজার এক রাত

১৯ কার্তিক, রাত পৌনে ১১টা। আকাশে আধখানা মরা চাঁদ। কুয়াশায় ভিজে ম্লান হয়ে গেছে চাঁদের আলো। যশোর থেকে এমনই এক রাতে সদলবলে রওনা হলাম মাগুরার দিকে। উদ্দেশ্য মাগুরার বিখ্যাত কাত্যায়নী পূজা দর্শন। যশোর থেকে শর্টকাট পথে খাজুরা আড়পাড়া হয়ে নিরিবিলি পাকা পথে মাইক্রোবাস ছুটে চলেছে।


মাঝেমধ্যে কুয়াশার ফালি রাস্তা আগলে দাঁড়াচ্ছে। তাই গাড়ির ছুটে চলাও মাঝেমধ্যে থমকে যাচ্ছে। অবশেষে ঘণ্টা দেড়েক পর সেখানে পৌঁছালাম। গাড়ি থেকে নেমে এবার হাঁটার পালা। মধ্যরাত। কিন্তু একি! সেখানে নেমে মনে হলো, হাজার হাজার মানুষের পদচারণে পুরো জনপদ যেন জেগে উঠেছে। রাস্তা ব্লক, কোনো গাড়ি চলছে না। কেবল মানুষ আর মানুষ। সবাই কাত্যায়নী পূজার দর্শনার্থী।
প্রায় দেড়-দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে প্রথমে হাজির হলাম নতুনবাজার এলাকায়। রাস্তাজুড়ে বিশাল এক কমলা রঙের তোরণ। আলো ঝলমল, লোক কলকল। ভিড় ঠেলে এগোনোই মুশকিল। এ শহরে কি এত লোকের বাস? আর সবাই কি হিন্দু? স্থানীয় অধিবাসী তপনকে জিজ্ঞেস করতেই বিষয়টা খোলাসা হয়ে গেল। বললেন, ‘কাত্যায়নী পূজা মাগুরার হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। মাগুরার লোকজন সারা বছর এই সময়টার জন্য মুখিয়ে থাকে। শ্যামাপূজার দীপাবলি শেষ হতেই শুরু হয় কাত্যায়নী পূজার উৎসব। এ বছর পয়লা নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। চলবে পাঁচ দিন। আজ মহা অষ্টমীর দিন। পরশু পূজা শেষ হবে। কিন্তু মেলা রয়ে যাবে প্রায় এক মাস। ছানাবাবুর বটতলায় সে মেলা বসে বিরাট আকারে। পূজাটা হিন্দুদের, কিন্তু উৎসবটা সবার। এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান—সবাই মিলে আনন্দ করে। পূজার সময় একসঙ্গে ঘুরে ঘুরে মজা করে, মণ্ডপে একসঙ্গে নাচে। মাগুরায় এ এক অপূর্ব মহামিলন।’
‘তাই বলে এত লোক!’ আমি বিস্ময় প্রকাশ করি।
‘মানুষ তো শুধু মাগুরার নয়, এসেছে পাশের অন্যান্য জেলা থেকে। নারী-পুরুষ, শিশু-বুড়ো—সবাই মেতেছে কাত্যায়নীর উৎসবে।’
ভারত থেকে আসা আশীষ বাবু বললেন, ‘কী করব, দাদা? সারা বছর এই একটা দিনের জন্য বসে থাকি। ভারতেও কাত্যায়নী পূজা এত জাঁকজমকের সঙ্গে হয় না, যা মাগুরায় এসে দেখতে পাই। এখানে নেপাল থেকেও লোক এসেছে। আশ্রমে উঠেছি, কেউ কেউ উঠেছেন তাঁদের আত্মীয়ের বাড়িতে। আমার মনে হয়, সারা পৃথিবীতে আর কোথাও এত বড় করে কাত্যায়নী পূজা করা হয় না।’
শোভিত তোরণ ও আলোকমালার ঝালরের নিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই মণ্ডপের সামনে। কিন্তু শত শত তরুণের ভিড়ে ভালো করে প্রতিমা দর্শন করা কঠিন। তারপর লেজার রশ্মির আলোর ঝলকানি, সাউন্ড বক্সে কান ফাটানো ধুুমধাম মিউজিক, ‘সে আমার পেয়ারি লাল রে..।’ সে মিউজিকের তালে তরুণদের সে কী উল্লাস আর নাচ! হালকা শীতেও ঘাম হচ্ছে। মিউজিক থামতেই শেষ হলো মণ্ডপের সামনে টগবগে তরুণদের দাপাদাপি। আর সেই সঙ্গে জ্বলে উঠল মণ্ডপের আলো। প্রতিমা দেখে কাত্যায়নী মাকে খুঁজতে শুরু করলাম। কেননা, মণ্ডপে যে প্রতিমা তা দেবী দুর্গার অবিকল রূপ। দুর্গার সঙ্গে আছে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। আছে মহিষাসুর। তাহলে আর এই পূজাকে কাত্যায়নী পূজা বলা কেন? একটা সরল উত্তর মনে মনে ঠিক করে নিলাম, হয়তো কার্তিক মাসে এই পূজা করা হয় বলেই নাম কাত্যায়নী পূজা।
মণ্ডপ থেকে বেরিয়ে ফের হাঁটতে হাঁটতে গেলাম নবগঙ্গা নদীর কূলে গৌর নিতাই গোপাল সেবাশ্রমে। সেখানেও বেশ মহাসাড়ম্বরে আর একখানা কাত্যায়নী পূজা হচ্ছে। ওই মণ্ডপের প্রতিমা দেখেই কিছুটা ভুল ভাঙল। প্রতিমা দেখতে দুর্গার মতোই, সামান্য একটু পার্থক্য আছে। কাত্যায়নী তথা পার্বতী বা দেবী দুর্গার কোলে শ্রীকৃষ্ণ বসে আছেন। ওখানকার শিবমন্দিরের পুরোহিত নন্দলাল কর্মকার বললেন, ‘এই আশ্রমের প্রতিমাই প্রকৃত কাত্যায়নী। প্রায় ২৪ বছর ধরে আশ্রমে কাত্যায়নী পূজা হয়ে আসছে। আগে মাগুরায় এই পূজা হতো। এখন শুধু পৌর এলাকার মধ্যেই আটটি পূজা হচ্ছে। সব মিলিয়ে যতদূর শুনেছি, মাগুরা জেলায় এবার ৮৫টা কাত্যায়নী পূজা হচ্ছে। তবে এখানকার কাত্যায়নী পূজার ঐতিহ্য বেশ পুরোনো। তা প্রায় ৬০-৬৫ বছর তো হবেই। তবে এ রকম মহাসাড়ম্বরে পূজা শুরু হয়েছে বছর ১০-১২ হলো।’
পুরোহিত মশাইকে আবার জিজ্ঞেস করি, ‘এ পূজাকে কাত্যায়নী কেন বলা হয়, জানেন কি?’
‘ঠিক বলতে পারব না, বাবা। তবে কার্তিক মাসে হিন্দুু মেয়েরা কাত্যায়নী ব্রত পালন করে। বিশেষ করে, অবিবাহিত মেয়েরা সময়মতো বিয়ে হওয়া এবং শ্রীকৃষ্ণের মতো বর পাওয়ার মনোবাসনায় এ ব্রত পালন করেন। হিন্দুশাস্ত্র মতে, দ্বাপর যুগে বৃন্দাবনবাসী গোপিনীরাও এ ব্রত পালন করতেন বলে জানা যায়। ব্রত পালন কী করে কাত্যায়নী পূজায় রূপ পেল, তা আমার জানা নেই।’
বললাম, ‘আর কোথায় কোথায় এ পূজা হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই জানেন?’
‘তা তো জানিই। নতুনবাজার, ছানাবাবুর বটতলা, বাটিকাডাঙ্গা বদ্যিবাড়ি, জামরুলতলা, সাতদোহা, আঠারোখাদা, বেণীপুকুর, গৌর নিতাই গোপাল আশ্রম—এসব জায়গায় গেলে আপনি আরও পূজামণ্ডপ দেখতে পাবেন।’
পুরোহিত মশাইয়ের কথামতো সব পূজা দেখে রাত ভোর করে যশোর ফিরে এলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম এক নবদুর্গা তথা কাত্যায়নী পূজার এক আলো ঝলমল উৎসবের স্মৃতি।
মৃত্যুঞ্জয় রায়

No comments

Powered by Blogger.