এই দিনে-বেতিয়ারা যুদ্ধের গৌরবগাথা

একাত্তরের ১১ নভেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুমহান গৌরবগাথায় যুক্ত হয়েছিল একটি উজ্জ্বল রত্নকণিকা। সেদিন দেশপ্রেম ও সাহসের রক্তিম আল্পনায় আত্মদানের এক অমর অধ্যায় রচিত হয়েছিল কুমিল্লার বেতিয়ারায়। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন—এই তিনটি বামপন্থী সংগঠনের যৌথ কমান্ডে পরিচালিত ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’র একটি সশস্ত্র যোদ্ধাদলের সঙ্গে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর এক তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল।


কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা অনেকটাই ‘হ্যান্ড টু হ্যান্ড কমব্যাট’-এর মতো মুখোমুখি সেই যুদ্ধে নয়জন গেরিলা শহীদ হয়েছিলেন। অমৃতের এই বীরসন্তানেরা সেদিন বেতিয়ারার শ্যামল মাটিতে বুকের রক্ত ঢেলে এক অমর বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস রচনা করেছিলেন।
ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের ‘বিশেষ গেরিলা বাহিনী’কে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল। ছোট ছোট গেরিলা দলে ভাগ করে আলাদাভাবে তাদের দেশের অভ্যন্তরের অপারেশন এলাকায় পাঠানো হতো। গেরিলাযুদ্ধের সাধারণ রেওয়াজ অনুসারে, কৃষকের বা পথচারীর ছদ্মবেশ ও পরিচয়ে এবং অস্ত্রপাতি ও সমর সরঞ্জাম উপযুক্ত কায়দায় ও পন্থায় নিজস্ব নাগালের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া হতো। শুরু থেকেই এই পদ্ধতি অবলম্বন করে দেশে প্রবেশ (ইনডাকশন) অথবা দেশের ভেতরে এক স্থান থেকে দূরের কোনো স্থানে যাতায়াত করা হতো।
নভেম্বর মাসে পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ-পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও প্রবলভাবে সংঘাতময় হয়ে ওঠে। আগরতলা শহরেও পাকিস্তানি বোমা পড়তে শুরু করে। এ রকম অবস্থার মধ্যেই বিশেষ গেরিলা বাহিনীর দুই গ্রুপের মোট ৩০-৪০ জনের একটি অপেক্ষাকৃত বড় দলকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার কোনো সুবিধাজনক স্থান দিয়ে একসঙ্গে দেশে পাঠানোর জন্য কিছুটা তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সীমান্তের উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সবারই ছদ্মবেশ ধারণ করে ইনডাকশনের সনাতন পদ্ধতির কিছুটা ব্যত্যয় ঘটানো হয়। তবে ট্রুপ মুভমেন্টের কনভেনশনাল পদ্ধতিও পুরোপুরি প্রয়োগ করা হয় না। কয়েকজনের হাতে গুলিভর্তি খোলা অস্ত্র, কিন্তু অন্য সবার ক্ষেত্রে ছালায় প্যাক করা অস্ত্র-গোলাবারুদ সহযোগে সিঙ্গিল ফাইলে মুভ করার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। যাওয়ার পথঘাট ও আশপাশের পরিস্থিতি আগে থেকে গেরিলা দল দ্বারা নিজস্বভাবে ‘রেকি’ (আগাম অনুসন্ধান) করে নেওয়া হয় না।
এই অবস্থার মধ্যেই ১১ নভেম্বর নিজামউদ্দিন আজাদ ও ইয়াফেজ ওসমানের নেতৃত্বে গেরিলা দলটি ‘বেইস ক্যাম্প’ থেকে প্রথমে সীমান্তবর্তী ভৈরবটিলার এক কিলোমিটার দূরের মিটিং স্পটে সমবেত হয়। ১১ নভেম্বর গভীর রাতে তারা সেখান থেকে মার্চ আউট করে। ভৈরবটিলা থেকে নেমে তারা সমতলের খেত-খামারের আইলের পথ ধরে এগোতে থাকে। গ্রামের সেই পথ ধরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার বেতিয়ারা গ্রামের পাশ দিয়ে সিঅ্যান্ডবি রোড ক্রস করা হবে—এটাই ছিল পরিকল্পনা। যে স্থান দিয়ে সিঅ্যান্ডবি রোড অতিক্রম করার কথা, তার এক-দুই কিলোমিটার উত্তরেই জগন্নাথ দীঘি এলাকায় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। তা ছাড়া সিঅ্যান্ডবি রোড দিয়ে হানাদার বাহিনীর সশস্ত্র মোবাইল পেট্রোল গাড়ির রুটিন যাতায়াত থাকত। গেরিলা দলের এত কথা জানা ছিল না।
ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে সিঙ্গিল ফাইলে এগিয়ে যেতে থাকে গেরিলা দল। সবচেয়ে সামনে লোডেড স্টেনগান নিয়ে লিডার নিজামউদ্দিন আজাদ। তাঁর পরপরই অস্ত্র রেডি পজিশনে নিয়ে কয়েকজন যোদ্ধা। তাঁদের পেছনে লম্বা লাইনে প্যাকিং করা অস্ত্রের বোঝা কাঁধে নিয়ে অন্য যোদ্ধারা। অল্পক্ষণের মধ্যেই সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে গেরিলারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেন। ‘প্রফেশনাল গাইডে’র কথা অনুসারে পথ তখন নির্বিঘ্ন থাকার কথা।
রাত তখন ঠিক ১০টা ৩০ মিনিট। হঠাৎ করেই সামনে থেকে আওয়াজ—‘হ্যান্ডস আপ!’ সঙ্গে সঙ্গেই গোটা দলের ওপর শুরু হয়ে যায় বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ। সামনে থাকা কমরেড আজাদ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্টেনগান থেকে পাল্টা ফায়ার শুরু করেন। তাঁর স্টেনগান গর্জে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খোলা অস্ত্র বহনকারী অন্য গেরিলারাও তাঁদের হাতে থাকা রাইফেল ও এলএমজি থেকে ফায়ারিং শুরু করেন। শত্রুসেনাদের দিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলির মুখে গেরিলারা লাইং পজিশনে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই খেতের আইলের পেছনে বা যে যেখানে পারেন কাভার নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এরপর আরও প্রচণ্ডভাবে গুলি আসতে থাকে তিন দিক থেকে। এই অবস্থায় কোনো রকম ‘রিট্রিট’ চিৎকার দিয়ে সবাইকে ক্রল করে পিছিয়ে আসতে বলা হয়। পেছনের সহযোদ্ধা সাথি কমরেডরা যেন নিরাপদে পিছু হটতে পারেন সে জন্য আজাদসহ অস্ত্র বহনকারীরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত গুলি চালিয়ে যান। সামনের কয়েকজনও প্রাণে বেঁচে যান। রাস্তার পাশেই শহীদ হন কমরেড নিজামউদ্দিন আজাদ। সেই সঙ্গে শহীদ হন গেরিলাযোদ্ধা আওলাদ হোসেন, বশির মাস্টার, শহীদুল্লাহ সাউদ, মো. দুদু মিয়া, মো. শফিউল্লাহ, আবদুল কাইউম। এই সাতজন গেরিলাযোদ্ধা ছাড়াও শহীদ হন পার্টির নেতা ও যে এলাকায় এই গেরিলা দলের যাওয়ার কথা সেখানকার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কমরেড সিরাজুম মুনীর এবং প্রফেশনাল গাইড আবদুল কাদের। এলাকাবাসীর কাছ থেকে পরে জানা গেছে যে তারা গুলির আওয়াজের মধ্যেই স্লোগান শুনতে পেয়েছে—‘জয় বাংলা, জয় সমাজতন্ত্র, দুনিয়ার মজদুর এক হও।’ বেতিয়ারা যুদ্ধের বীর শহীদদের কণ্ঠ থেকে এগুলোই ছিল শেষ আওয়াজ।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)।

No comments

Powered by Blogger.