ঐতিহ্য-পদ্মার ইলিশ by সাইফুদ্দীন চৌধুরী

পদ্মা নদী দুই পরিচয়ে খুবই মশহুর—প্রমত্তা হয়ে কীর্তিনাশা আর ভোজনরসিক বাঙালির রসনা তৃপ্তির জন্য ইলিশ উপহার দেওয়া। পদ্মা নদী নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে প্রচুর। চর্যাপদ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পদ্মা নদী নিয়ে এতই লেখালেখি হয়েছে যে গবেষকেরা বলেন, আর কোনো নদী নিয়ে নাকি অতটা হয়নি।


পদ্মার ইলিশ নিয়েও আছে অনেক লেখা। বড় কথা হলো, মাছখেকো বাঙালির খাদ্যের তালিকায় ইলিশ তো অনেক কাল আগে থেকেই জায়গা করে নিয়েছে। প্রাচীন টীকাকার জীমূতবাহন এক জায়গায় লিখেছেন, ইলিশ মাছ কেবল সুস্বাদু খাদ্যবস্তুই নয়, ইল্লিশ বা ইলিশের তেলও সেকালের মানুষ নানাভাবে ব্যবহার করেছে।
সবচেয়ে সুস্বাদু ইলিশ হতো পদ্মা নদীতে। এই পদ্মার ইলিশের অসাধারণ বর্ণনা আছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে। উপন্যাসের শুরুই হয়েছে বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে পদ্মায় ইলিশ ধরার বর্ণনা দিয়ে। বহু ভাষাবিদ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জলপথে বার্মা যাওয়ার পথে পদ্মা নদীতে যে ইলিশ ধরা দেখেছেন, তার চমৎকার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় তাঁর ‘ইনসানিয়াত’ গল্পে।
বাঙালির প্রিয় এই মাছের রয়েছে হরেক রকমের রেসিপি। ঝোল ইলিশ, সরষে ইলিশ তো আছেই। এর সঙ্গে আছে ইলিশ পোলাও, ইলিশ খিচুড়ি, ইলিশ বিরিয়ানি। এ ছাড়া আরও যোগ হয়েছে ভুনা ইলিশ, কচুপাতা ইলিশ, ইলিশ কাবাব, পিঠা ইলিশ, প্রেজেন্টেশন ইলিশ ইত্যাদি নাম। বাঙালির নতুন বছরের উৎসব ইলিশ-পান্তা ছাড়া তো জমেই না।
আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ। প্রতিবছর এ থেকে আসে বেশ কিছু বৈদেশিক মুদ্রা। তবে, রপ্তানি করা ইলিশের সুনাম বেশি ছিল পদ্মার ইলিশে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয়, এই ইলিশে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি এসিড থাকায় মানুষের দেহে ইনসুলিনের মাত্রা কমিয়ে দিতে সাহায্য করে। হয়তো ঔষধি গুণ থাকার কারণেই ঢাকার মোগল সুবেদারদের কাছে এই ইলিশ উপাদেয় খাদ্য হয়ে উঠেছিল।
পদ্মার ইলিশের সেই ঐতিহ্য আর নেই। গভীর পানির মাছ ইলিশ বঙ্গোপসাগরের লোনা পানি থেকে উঠে আসত পছন্দের স্থান মিঠা পানির পদ্মা নদীতে, ডিম দিত এখানে। মা ইলিশেরা এখানেই বাস করত। উত্তর ভারত হয়ে আসা পদ্মার এখন বড়ই করুণ দশা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীই হারিয়ে যাচ্ছে।
আগে ডিম ছাড়ার জন্য ইলিশ বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পদ্মা, মেঘনা নদীতে আসত। ওই নদীতেই ছিল তাদের অবাধ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ। ইলিশের সেই আনাগোনা কমে গেছে। এখন বরং ভারতের জলসীমার দিকে এদের যাতায়াতের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ‘ডাউন টু আর্থ’ নামের এক ওয়েবসাইটে দেখা যায়, পদ্মা নদীর এই ইলিশ চলে যেত ফারাক্কা হয়ে ভারতের উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত। ফারাক্কা বাঁধের ফলে সে পথ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখন ভারত মহাসাগর হয়ে এই ইলিশ চলে যাচ্ছে গুজরাটের নর্মদা ও তপতী নদীতে। ভারত মহাসাগরের দিকে ইলিশ চলে যাওয়ার আরেকটি কারণ বাংলাদেশের জলসীমার মধ্যে ডুবোচরের সংখ্যা অধিক মাত্রায় বেড়ে যাওয়া।
পদ্মার ইলিশ না পাওয়ার উল্লিখিত কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশের অভ্যন্তরের নদীদূষণের বিষয়টিও। যেটুকু ইলিশ এখনো উজান বেয়ে পদ্মায় আসে, তার পুরো অংশ ইলিশ হিসেবে পাওয়া যায় না। পোনা বা জাটকা ইলিশ অবাধে ধরা হয় পদ্মা-মেঘনায়। সরকার মার্চ থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জাটকা ধরা বন্ধের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ঠিকই, কিন্তু কে শোনে কার কথা? সনাতন ধর্মে লক্ষ্মীপূজা আর সরস্বতী পূজার মধ্যবর্তী সময়ে ইলিশ খাওয়া নিষিদ্ধ আছে। বস্তুত, এই সময়টি ইলিশ মাছ বড় হওয়ার সময়। হয়তো এ কারণেই সরকার জাটকা ধরা বন্ধের আদেশ জারি করে। সরকারের একটি সূত্র থেকে জানা যায়, থাইল্যান্ড থেকে আনা সূক্ষ্ম কারেন্ট জালে প্রতিবছর অবৈধভাবে ১০ থেকে ১৫ হাজার জাটকা ইলিশ ধরে জেলেরা।
১৯৫৩ সালের মৎস্য সংরক্ষণ আইনে নয় ইঞ্চির কম পোনা বা জাটকা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। শুধু জাটকা ধরাই নয়, এর ক্রয়-বিক্রয়, হেফাজতে রাখা ও পরিবহনও আইনত নিষিদ্ধ করা হয়। আইনটি অবশ্য ১৯৯৯ ও ২০০৩ সালে আরও সংশোধন ও সংস্কার করা হয়। কিন্তু এই আইনের কার্যকারিতা রয়ে গেছে শুধু কাগজে-কলমে। ওই আইন অমান্য করে অবাধে জাটকা ধরে হাটে-বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
যদি আমরা ইলিশ মাছের ঐতিহ্য ফিরে পেতে চাই, তাহলে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু পদ্মা নদীই নয়, বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী অন্যান্য নদীর সঙ্গে পদ্মা নদীর সংকোচন রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। নদীতে বর্জ্য নিষ্কাশন বন্ধ করতে হবে, যাতে পানি দূষিত না হয়। বন্ধ করতে হবে কারেন্ট জালের উৎপাদন ও ব্যবহার। জাটকা ধরা বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীকে সমন্বিতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে মিডিয়ার সহযোগিতায়। অন্যথায় ইলিশের সেই গান: জামাই ভুলানো মাছ ইলশা রে/ বিহাই ভুলানো মাছ ইলশা রে/ একদিন হারিয়ে যাবে। উন্মুক্ত বুকে, পার হয়ে যায় গরু/ পার হয় গাড়ি—শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার চিরায়ত দৃশ্য। শঙ্কা হয়, এর সঙ্গে বাঙালির প্রিয় ইলিশও কি হারিয়ে যাবে?
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক। অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.