মনের কোণে হীরে-মুক্তো-দুর্নীতিবিরোধী সৎ ব্যক্তি এবং কর্মকর্তাদের সুরক্ষণ by ড. সা'দত হুসাইন

দুর্নীতিমুক্ত স্বদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে দেশে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এসব সংস্থার উদ্যোক্তা এবং কর্মীরা সংগঠনের লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের মূল কাজ হচ্ছে দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা জোরদারকরণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে জনসমক্ষে তাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং সম্ভব হলে দুর্নীতি দমন-সংক্রান্ত সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোকে সহায়তা প্রদান।


বর্তমান পর্যায়ে বছরে দুই-একবার র‌্যালি অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার আয়োজন, রচনা প্রতিযোগিতা, ব্যানার-পোস্টার টাঙানোর মধ্যে বেসরকারি সংস্থার কার্যাবলি সীমিত থাকছে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা চালানো, তাদের আটক করা অথবা বিচারের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের কাজ দুর্নীতি দমন কমিশন এবং অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা বা বিচার বিভাগ সম্পাদন করে থাকে।
সন্দেহজনক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রাক-মামলা পর্যায়ে বিভিন্ন রকম তদন্ত অনুষ্ঠান, উপযুক্ত ক্ষেত্রে অভিযোগপত্র দাখিল করে মামলা শুরু এবং সম্ভব হলে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। মামলায় যথাযথ শাস্তি প্রদান করা হলে দুর্নীতি নিরুৎসাহিত হয়। এ কথা সত্যি যে দুর্নীতির মামলায় আদালতে খুব কমসংখ্যক অভিযুক্ত ব্যক্তি শাস্তি পেয়ে থাকে। তবে তদন্ত অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের নিয়ে যে টানাহেঁচড়া চলে, সেটিই অভিযুক্তদের জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি, যদিও কিছু নিরীহ নিরপরাধ ব্যক্তি এর ফলে অন্যায়ভাবে হয়রানির শিকার হয়ে থাকে।
দুর্নীতি এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর যৎকিঞ্চিৎ কার্যাবলি পরিদৃষ্ট হলেও সৎ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের সুরক্ষণের জন্য এসব সংস্থা থেকে আজ পর্যন্ত কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়নি। অথচ দুর্নীতি নিরসনের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় করণীয় হচ্ছে, সৎ ব্যক্তি এবং কর্মকর্তাদের সুরক্ষণ। সৎ ব্যক্তি এবং কর্মকর্তারা প্রায়ই নিরীহ এবং আর্থিক দিক থেকে অসচ্ছল থাকেন। তাঁরা দলবাজি করেন না, গোষ্ঠীবদ্ধ অবস্থায় থাকেন না। এককথায় তাঁদের ধনবল এবং জনবল কম থাকে। পক্ষান্তরে দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল থাকে, তারা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে থাকে। সমাজ এবং সরকারের অনেক প্রভাবশালীর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকে।
তাদের ক্ষমতা বেশি। তারা এত অপকর্ম করতে পারে, এত অপকৌশলের আশ্রয় নিতে পারে, যা একজন সৎ এবং নিরীহ ব্যক্তি বা কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তিনি এত নিচে নামতে পারেন না, একজন দুর্নীতিগ্রস্ত, নীচু প্রকৃতির লোক মুহূর্তে কারো গায়ে পড়তে পারে, আবার পরমুহূর্তেই তার পায়ে পড়ে মাফ চাইতে পারে। তার কোনো আত্মমর্যাদাবোধ নেই। একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সৎ ব্যক্তি এমনটি করতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবে শক্তির জগতে, কৌশলের খেলায় তিনি তেমন সুবিধা করতে পারেন না। বাস্তব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে তাঁকে বিপদে পড়তে হয়। তাঁকে সাহায্য করার কেউ থাকে না। সৎ ব্যক্তি বা কর্মকর্তার আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতরা মনে করে যে যেহেতু এই ব্যক্তি তাদের কোনো বাড়তি সুবিধা দেবে না, তাই তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করে কোনো লাভ নেই। অতএব তারা সৎ ব্যক্তি বা কর্মকর্তা থেকে দূরে সরে থাকাকেই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন ছাড়া যেই কর্মকর্তারা চাকরি পান, তাঁদের মধ্যে অতি নগণ্যসংখ্যক কর্মকর্তা চাকরির প্রথম থেকেই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের কথা চিন্তা করে থাকেন। ব্যতিক্রমধর্মী দু-একজন ছাড়া প্রায় সব কর্মকর্তাই সৎভাবে জীবনযাপনের ইচ্ছা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেন। সৎভাবেই তাঁরা জীবিকা অর্জন করতে চান। কিন্তু পারিপাশ্বর্িক অবস্থার চাপে তাঁরা অসৎ উপার্জনের দিকে অগ্রসর হন। দুর্নীতিবাজরা তাদের অন্যায় সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এ চাপ কার্যকরভাবে প্রতিহত করা নবীন কর্মকর্তার পক্ষে প্রায়ই সম্ভব হয় না। শুধু উচ্চ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নগণ্যসংখ্যক নবীন কর্মকর্তা এ ধরনের চাপ প্রতিহত করতে পারেন। তবে এতে তাঁদের বিরুদ্ধে অনেক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ শত্রু সৃষ্টি হয়।
সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন তাঁর নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এবং সহকর্মীরা অন্যায় বা অসৎ কাজ করার জন্য তাঁকে চাপ দিতে থাকে। এ চাপে কাজ না হলে তারা সৎ কর্মকর্তার বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে। তাঁকে নানাভাবে অপদস্ত করতে শুরু করে। তাঁকে বিপদে ফেলতে চেষ্টা করে। আমার এক-দুজন বন্ধুকে তাদের দুর্নীতিবাজ সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন এবং অধস্তন কর্মকর্তা একজোট হয়ে একাধিকবার বিপদে ফেলেছে। তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করেছে। তাঁদের নিজস্ব প্রতিরোধক্ষমতা, মানসিক দৃঢ়তা, উদ্যোগ এবং সর্বোপরি অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার কারণে তাঁরা রক্ষা পেলেও আর্থিক এবং মানসিকভাবে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। আল্লাহ তাঁদের সহায় হয়েছেন।
সৎ কর্মকর্তাকে ক্ষেত্রবিশেষে কোর্ট-কাচারি এবং পুলিশি হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। অর্থ-বিত্ত, জনবল এবং ভালো কৌশলী না থাকায় মামলায় তাঁদের অসুবিধায় পড়তে হয়। তাঁরা হেয়প্রতিপন্ন হন। কাচারিপাড়ার পাল্লায় পড়ে আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত এবং মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হন। মামলা-হামলা ছাড়াও তাঁরা সাধারণত যেসব বিরক্তিকর মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হন তা হলো, বেনামি চিঠি, টেলিফোনে হুমকি, পোস্টারিং, লিফলেটিং, পত্র-পত্রিকায় দুরভিসন্ধিমূলক সংবাদ প্রকাশ, অফিসের কর্মচারীদের দিয়ে আন্দোলন করানো, স্লোগান, মিছিল করানো, অফিসিয়াল কাগজপত্র চুরি করানো, অফিসকক্ষে আপত্তিকর কাগজপত্র রেখে দেওয়া, নারীঘটিত কেলেংকারির মিথ্যা অভিযোগ আনা ইত্যাদি। এ ধরনের অপকৌশল ও চাপের মুখে সৎ কর্মকর্তা অনেক সময় নাজেহাল বা নাস্তানাবুদ হন। তাঁর জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। তাঁকে একাই সব বিপদ সামাল দিতে হয়।
সমাজ এবং সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, দেশের স্বার্থে সৎ কর্মকর্তা ও ব্যক্তিকে সহযোগিতা করা, তাঁদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। সৎ ব্যক্তিকে ক্ষমতায়ন করা হলে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। কাজকর্ম দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে ভালোভাবে সম্পন্ন হয়। কাজের গতি আসে এবং সেবার গ্রাহকরা হয়রানি ও অত্যাচার থেকে রেহাই পায়। এর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে সৎ লোকের পাশে দাঁড়ানো, দলবেঁধে পাশে দাঁড়ানো। তাঁকে সাহস জোগানো, শক্তি জোগানো, সম্ভব হলে সৎ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের একটি নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করা যেতে পারে। তাঁদের সংগঠিত করা যেতে পারে, যাতে দুর্নীতিবাজদের বিপক্ষে তাঁরা একটি কার্যকর শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
সৎ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের সুরক্ষণের জন্য বর্তমানে দেশে কোনো সংগঠন বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান নেই। দেশে দুর্নীতি নিরসন করতে হলে সৎ ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের সুরক্ষণের লক্ষ্যে অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা অত্যাবশ্যকীয়। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন হিসেবে রূপ দেওয়ার পাশাপাশি সৎ কর্মকর্তাদের সুরক্ষণের জন্য এই প্রতিষ্ঠান কর্মসূচি গ্রহণ করবে। বিপদগ্রস্ত কর্মকর্তাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা প্রদান করবে। সুনামধারী সৎ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে যতদূর সম্ভব তাঁদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা যেতে পারে। যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এ তালিকা সম্প্রসারিত করা সমীচীন হবে। সৎ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংযোগ সৃষ্টি করে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যেতে পারে। যত শিগগির সম্ভব দেশে এরূপ একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সময়োপযোগী পদক্ষেপ হবে।

লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, পিএসসি
এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

No comments

Powered by Blogger.