সহজ-সরল-রাতে আমি শান্তিতে ঘুমাই by কনকচাঁপা

পান্থশালার মতো একটা পৃথিবী_তাও কয়দিনের, কত বছরের জন্য স্থায়ী, কেউ আমরা জানি না। তবু কত লোভেই না আমরা পড়ি। জমিজমা, টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, সুনাম-সম্মান, আরো কত কিছু! তবে যাঁরা আমায় কাছে থেকে চেনেন, তাঁরা জানেন অনেক ধরনের লোভ থেকেই আমি মুক্ত। মনের কোনায় মেঘের মতো লোভের আভাস দেখা দিলেই দুই হাতে তা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।


গানের জন্য যা মান-সম্মান, প্রয়োজনমতো টাকাপয়সা_তা এমনি এমনি বা ওই গানের সুরের টানেই আসে। সেজন্য কোনো লোভ-বাসনা-আকাঙ্ক্ষা কিছুই নেই। তার পরও যদি কিছুর লোভে পড়ি_তো সোজা আয়নায় তাকাই এবং নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করি এবং লজ্জিত হই_নিজেই নিজের মুণ্ডুপাত করি। কিন্তু লোভটা দমাতে পারি না। এক টুকরো বাগানের_ঘনবৃষ্টিতে ভেজা বাগানের বড়ই লোভ আমার। সেটা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেন যেন করা হয়ে উঠছে না। তাই বাসার বারান্দায়ই মনের আশা ও শখ পূরণের চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু মাটির মায়া কি টবের আদরে ভরে? তবুও আমার বারান্দায় টবে মরিচ, লেবু-বাগানবিলাস, বেলী, হাসনাহেনা, নানা রকম পাতাবাহার, নিম_অ্যালোভেরা, গন্ধরাজ, পুদিনা, তুলসী, থাইপাতা, কারিপাতা, গ্রাম থেকে তুলে আনা গন্ধভাঁদাল, খোকসা, দূর্বাঘাস, কয়েক রকম কচু, মানিপ্লান্ট, মৌসুমি সবজি, টমেটো, ধনেপাতা, এমন অনেক গাছই থাকে। বারান্দায় আমার গাছগুলো মাঝেমধ্যে পাখি ডেকে আনে। বেশি বেশি পাখি না ডাকতে পারলেও পোকামাকড়কে ঠিকই আকর্ষণ করে। হয়তো তারা গাছের পাতাতেই ডিম ফুটে বড় হয়েছে, নয়তো মাটির মধ্যে ঘুমিয়ে ছিল, সেখান থেকে প্রাণ পেয়েছে বা উড়ে এসে অভিবাসী হয়েছে। এমন একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। সকালে আমার বারান্দায় সূর্য ফুটতেই পর্দা সরিয়ে গাছের দিকে স্নেহান্ধ দৃষ্টি দিয়ে তাকাই। বড় আদর লাগে। একদিন হঠাৎ দেখি লেবুগাছের নিচে অনেক গোলমরিচ ছিটানো। ওখানে গোলমরিচ কেন? রোদে দিয়েছিলাম? গা ঝাঁকি দিয়ে উঠল। ওগুলো তো গোলমরিচ না! তবে? ওগুলো এক ধরনের সবুজ শুঁয়োপোকার বিষ্ঠা। এবার গাছের পাতার দিকে তাকাই। ওমা! পাতাগুলো খেয়ে একদম ন্যাড়া করে ফেলেছে! কোথায় সেই দুষ্ট অতিথি? থাই গ্লাস খুলে এবার কাছে যাই। দেখি এক আঙুল মোটা_আঙুলের চেয়েও লম্বা তুলতুলে সবুজ শুঁয়োপোকা পাতায় বসে বসেই কুচ কুচ করে পাতা খাচ্ছে। ইস, ভেজিটেরিয়ান সাহেব। তা এত গাছ বাদে আমার গাছে কেন বাবা_দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি! ভালো করে তাকালাম, একটা পাতা ছিঁড়ে তাতে ওটাকে তুললাম এবং মাটিতে রাখলাম। কী যে সুন্দর! ঘন সবুজ। মাঝে কালো ও ঘিয়ে ডোরা। সবজি খেয়েও নধরকান্তি দেহ। সে তখনো খেয়ে যাচ্ছে। আমি ভিডিও ক্যামেরাটা বের করে ভিডিও করলাম। একসময় খাওয়া বাদ দিয়ে গোল হয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ল ও। যেন ক্লান্তি ভর করল। আবারও গা ঝাঁকি দিয়ে উঠল। মায়া লাগছিল। মায়া লাগার কোনো কারণই নেই। তবু আমার মন তো, তার কি কোনো ব্যাকরণ আছে! যে পাতায় বসেছিল সে পাতার গোড়ায় ধরে বারান্দা দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। জানি, তাতে ওই পোকাটার কিছু হবে না। দিব্যি বেঁচে থাকবে। অতবড় পোকাটাকে কোনোভাবে আমার পক্ষে মেরে ফেলা সম্ভব হবে না। আবার ওকে রাখলে ভেজ-সাহেব গাছের বারোটা বাজাবে। ফেলে দিতে দিতে ভাবলাম, আল্লাহর কী সৃষ্টি! সব কিছুতেই সৌন্দর্য, ছন্দ, অবয়ব, রঙের সমন্বয়। কী অপূর্ব তাঁর সৃষ্টি। সেটা বড় হোক কি ছোটই হোক। তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই আমি তাঁকে খুঁজি। তাঁকে খুঁজি ফুলের সুগন্ধে, নদীর বহমানতায়, আকাশের বিশালতায় আর অপেক্ষায় থাকি এই পান্থশালার কর্মসূচি শেষে কখন তাঁর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াব। এই পৃথিবীতে আমার কোনো লোভ নেই_বাড়ি-গাড়ি, জমিজিরাত, কিছুই না। তবে ভালোবাসি সুর, প্রকৃতি, মা-বাবা, সন্তান-স্বামীর সানি্নধ্য, মানুষের হাসিমুখ, শিশু ও ফুল। আমার এমন কোনো সহায়-সম্পত্তিও নেই আবার কোনো দেনাও নেই। যা ঋণ আছে আপামর জনতার কাছে, ভালোবাসার ঋণ। সে অনুভব বড় সুখের। আমি সুখী মানুষ কি না জানি না, তবে রাতে আমার খুব ভালো ঘুম হয়।
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.