স্মরণ-তিতুমীর: মুক্তিকামী মানুষের অগ্রপথিক

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা তথা বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি তিতুমীর। তিতুমীরের নেতৃত্বে অতিসাধারণ হাতিয়ার নিয়ে বাঙালিরা সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীকে বারাসাতের যুদ্ধে পরাজিতও করেছিলেন। পুরো নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী।


জন্ম পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমায় ১৭৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি আজকের এই দিনে। তিতুমীর স্থানীয় মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্ত কর্রে১৮২২ সালে হজব্রত পালন করতে মক্কা শরিফ গমন করেন। হজব্রত পালন শেষে তিনি আরবের বিখ্যাত ইসলামি শিক্ষাবিদ, ধর্মসংস্কারক এবং ইসলামি বিপ্লবের নেতা সায়্যিদ আহমদ বেরেলভির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সায়্যিদ আহমদই তাঁকে বাংলায় ফিরে গিয়ে মুসলমানদের ইসলামবিরুদ্ধ কার্যকলাপ থেকে মুক্ত করার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। সৌদি আরবে পাঁচ বছর শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ১৮২৭ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে তিনি চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলার মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি অনুশাসন প্রচারের কাজ শুরু করেন। তিতুমীরের এই ইসলামি অনুশাসন প্রচারকে কেন্দ্র করেই স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্যের সূচনা হয়। স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষের অন্যতম কারণ ছিল ‘পুণ্যাহ’ নামের এক অনুষ্ঠানের বিরোধিতা। তিতুমীর জমিদারদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে শুরু করলে জমিদারেরাও খেপে গেলেন। তাঁরাও আন্দোলন দমন করার জন্য শুরু করলেন অত্যাচার। এ কারণ্রেতিতুমীরের আন্দোলন ধীরে ধীরে গণ-আন্দোলনে রূপ নিতে শুরু করে। যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল পুণ্যাহকে কেন্দ্র করে, সেটাই দ্বিতীয় পর্যায় এসে রূপ নিল অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রজাদের প্রতিরোধ আন্দোলনে—এককথায় শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের আন্দোলন—যার নায়ক ছিলেন তিতুমীর। চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলার জমিদারেরা তাই একজোট হয়ে তিতুমীরের আন্দোলন প্রতিহত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। তিতুমীর তাঁর আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তুলতে লাগলেন। তিনি এই প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য গঠন করলেন মুজাহিদ বাহিনী। তাঁর এই বাহিনীর সদস্যদের তিনি শরীরচর্চার পাশাপাশি লাঠি চালানোসহ অনেক রকম দেশীয় অস্ত্র পরিচালনারও শিক্ষা দিলেন। তিতুমীরের এই মুজাহিদ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন তাঁরই ভাগনে এবং শিষ্য গোলাম মাসুম। তিতুমীরের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় জমিদারেরা শঙ্কিত হয়ে ইংরেজ শক্তির শরণাপন্ন হলেন। গোবরডাঙ্গার জমিদার কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলো মোল্লাহাটের ইংরেজ কুঠিয়াল ডেভিসের সঙ্গে। জমিদার ও ইংরেজদের স্বার্থ একই ছিল বলে ডেভিসও এই প্রজাবিদ্রোহ দমনে এগিয়ে এলেন। তিনি কয়েক শ সৈন্য নিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। কিন্তু তারা তিতুমীরের শক্তিশালী মুজাহিদ বাহিনীর কাছে পরাজিত হলো এবং ডেভিস নিজেও নিহত হলেন। আরেক যুদ্ধে তিতুমীরের মুজাহিদ বাহিনীর হাতে নিহত হলেন গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রায়। এরপর তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলেন বারাসাতের কালেক্টর আলেকজান্ডার। তিনি বশিরহাটের দারোগাকে সঙ্গে নিয়ে তিতুমীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজিত ও নিহত হন। এ ঘটনায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ইংরেজ শক্তি তিতুমীরের প্রতি প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসে উঠল। পরিস্থিতি ক্রমেই আরও জটিল আকার ধারণ করল। বিপদ যে সামনে ঘনিয়ে আসছে, সেটা বুঝতে পারলেন তিতুমীর। তাই নিজের প্রতিরোধের ভিতকে আরও শক্তিশালী করতে ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসে নারিকেল বাড়িয়ায় এক শক্তিশালী এবং দুর্ভেদ্য বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করলেন। পাশাপাশি নিজের মুজাহিদ বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে লাগলেন। স্থানীয় মুসলমান তাঁতি ও কৃষকেরা দলে দলে এসে তাঁর মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দিতে লাগলেন। তাঁদের সবার কাছে তিতুমীর তখন একটি শক্তি আর আদর্শের প্রতীক। দেখতে দেখতে তিতুমীরের দলের মুজাহিদের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেল। তিতুমীরের লক্ষ্যও পাল্টে গেল। তিনি তখন নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করলেন। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে জেহাদে শামিল হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি জোর আহ্বান জানালেন। এরপর তিনি নদীয়া ও চব্বিশ পরগনা জেলায় নিজের বাদশাহী আধিপত্য বিস্তার করে স্থানীয় জমিদারদের কাছে কর দাবি করে নোটিশ পাঠালেন। যে সংগ্রামের শুরু হয়েছিল ধর্মীয় আবেগের বশবর্তী হয়ে, ইংরেজরা স্থানীয় জমিদারদের পক্ষ নেওয়ায় তা দাঁড়িয়ে গেল ইংরেজবিরোধী সংগ্রামে তথা দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে। ইংরেজ বাহিনী লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ১০০ অশ্বারোহী, ৩০০ জন পদাতিক এবং দুটি কামান নিয়ে তিতুমীরের মুজাহিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করলেন। মুজাহিদ বাহিনী তাঁদের সাবেকী অস্ত্র তথা ঢাল, সড়কি, লাঠি, তলোয়ার নিয়ে এবার আর ইংরেজ বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং কামানের সামনে দাঁড়াতে পারল না। তারা পিছুহটে আশ্রয় নিল বাঁশের কেল্লার ভেতরে। সেখানে গিয়েও শেষ রক্ষা হলো না। ইংরেজ বাহিনী কামানের গোলা বর্ষণ করে বাঁশের কেল্লা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল। ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর এই শেষ এবং রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বিপুলসংখ্যক মুজাহিদের পাশাপাশি তিতুমীরও শহীদ হন। স্বাধীনতার স্পৃহা কতটা গভীর হলে একটি সুসংগঠিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঁশের কেল্লার মতো ভঙ্গুর প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করে একজন মানুষ লড়াই করার মতো সাহস দেখাতে পারেন, তিতুমীর তা দেখিয়েছিলেন। তাই এ দেশের মানুষ আজও তিতুমীরের সেই লড়াকু মানসিকতাকে হূদয়ে ধারণ করে সব অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পায়। আজ তিতুমীরের ২২৯তম জন্মদিন। এই দিনে চিরসংগ্রামী মানুষটির প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
 সুরঞ্জিত বৈদ্য

No comments

Powered by Blogger.