সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে জরুরি

ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারের মুদ্রানীতি পুরোপুরি সংকোচনমূলক। এ মুদ্রানীতি থেকে অনুমান করা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক যেকোনো উপায়ে মূল্যস্ফীতি রোধ করতে চায়। আপাতত বাজারে সার্বিক মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়াটাকেই সহজ উপায় বলে ধরে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে পথেই পা বাড়িয়েছে। এ ছাড়া কোনো সহজ পথও বোধ হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে খোলা ছিল না।


কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিম্নগতির প্রবণতায় বাংলাদেশ ব্যাংক সম্ভবত বাধ্য হয়েই এ রকম 'সংযত' হতে চেয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল সাত শতাংশ। বৃহস্পতিবার ঘোষিত মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, অর্থবছরের প্রথমার্ধে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণই ছিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্থরতার কারণে দেশের রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। অন্যদিকে বিদেশি সহায়তা কমে যাওয়া এবং দেশে ঋণ সরবরাহ-পরিস্থিতি অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে সীমিত করবে। এ অবস্থায় জিডিপির প্রবৃদ্ধি শেষ পর্যন্ত সাড়ে ছয় থেকে সাত শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের এ আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। একদিকে বিশ্ব খাদ্য মূল্যস্ফীতির বিলম্বিত প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পড়বে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির বিরূপ প্রভাবও অর্থনীতিতে পড়বে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা ডিসেম্বরে ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমেছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিম্নগামী হয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি এটাও মানতে হবে, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি এখনো বাড়ছে। মূলত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণেই এমনটি ঘটছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। মুদ্রানীতি বিবৃতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, দেশের আমদানি-বাণিজ্য বরাবরের মতোই রপ্তানির চেয়ে বেশি। এটাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা। তবে দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী-আয় বাণিজ্য ঘাটতি মেটাতে বিশেষ অবদান রেখে এসেছে। সম্প্রতি সরকারি খাতে বিদেশি সহায়তা এ সময়ে বিশেষভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় লেনদেন ভারসাম্যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এক বছরের মধ্যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার মান ১৫ শতাংশ কমে গেছে। টাকার এই অবমূল্যায়নও অর্থনীতিতে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। মুদ্রানীতির একটি ইতিবাচক দিক হলো, পুঁজিবাজারকে উৎপাদনশীল খাত হিসেবে বিবেচনা করা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধারণা করছে, কর্মসংস্থানের বিকল্প ক্ষেত্র হিসেবে পুঁজিবাজার উন্নয়নের চালিকাশক্তি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতিনির্ধারণী সুদহার (সিআরআর, এসএলআর, রেপো, রিভার্স রেপো) আরো বাড়াবে। এর মাধ্যমে মুদ্রাপ্রবাহের রাশ টেনে ধরা হবে। এর ফলে ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়বে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমবে। কমবে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদন। বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমবে_এটাই স্বাভাবিক। আবার চাহিদা কমলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋণের জোগান পরিমিত রাখার কারণে যদি অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে আর এটি যদি প্রত্যাশিত জিডিপি অর্জনে বাধার সৃষ্টি করে, তবে এর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই দায়ী থাকবে। কারণ মুদ্রানীতিতে এটি স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। আর এ কারণেই ঋণপ্রবাহ কমালে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জেনেও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির দিকে হেঁটেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মূল্যস্ফীতি এখন দেশের বড় একটি সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিয়েছে। দেশের অর্থনীতিকে স্বস্তিদায়ক করতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার বিকল্প নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতিতে তারই প্রতিফলন ঘটাতে চেয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.