রফতানি নিষেধাজ্ঞার কবলে কাঁচাপাটঃ সিদ্ধান্ত যেন নেতিবাচক না হয়

উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাংলাদেশ তার ‘সোনালি আঁশ’খ্যাত পাটশিল্পের গৌরব সমূলে হারাতে বসেছে। বহু বছর ধরেই পাট আর দেশের অন্যতম ফসলের তালিকায় নেই। পাট উত্পাদনের ক্রমবর্ধমান দুর্দশা কাটাতে সরকার কোনো সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়নি।
একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পাটকল। আদমজি পাটকল বন্ধ ঘোষণার পর থেকে পাট উত্পাদনে যে ধস নেমেছিল, তা থেকে আর রেহাই পাওয়া সম্ভব হয়নি। বরং সরকারের বিভিন্ন ভ্রান্ত নীতির কবলে পড়ে পাটের উত্পাদন কমছে, পাশাপাশি কাঁচাপাট রফতানি এলোমেলো হয়ে পড়ায় সংকুচিত হয়ে আসছে বিশ্ববাজার। এ অবস্থা চলতে থাকলে স্বভাবতই পাটচাষীরা বিকল্প চাষের দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হবে, বন্ধ হয়ে যাবে সব পাটকল এবং ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়াবেন পাট ব্যবসায়ীরা।
১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের মতো বর্তমান সরকার একই কায়দায় সম্প্রতি কাঁচাপাট রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে এরই মধ্যে পাটখাত চাঙ্গা হওয়ার যে লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, তার ওপর পড়েছে খাঁড়ার ঘা। দীর্ঘদিন পর ভালো দাম পাওয়ায় চাষীরা পাটচাষে ফিরে আসাতে যে উত্সাহবোধ করেছিলেন, তাতে দেখা দিয়েছে ভাটার টান। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে পাটের দাম পড়ে যাবে এবং তার জের হিসেবে আগামী মৌসুমে পাটচাষের পরিমাণ কমবে। পাট ব্যবসায়ীদের মতে, কাঁচাপাট রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা বলবত্ থাকলে প্রতিবেশী দেশ ভারতে কাঁচাপাট পাচার হবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কাঁচাপাট পাচারের আশঙ্কা খুব একটা নেই। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাট সচিব। কিন্তু তার কথা থেকেই আঁচ করা যায়, খুব একটা আশঙ্কা না থাকলেও পাট পাচার বন্ধ হবে না। সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, ভারতকে রফতানি করা বাংলাদেশী পাটের মুখাপেক্ষী হতে হবে না, পাচার হওয়া পাটেই তাদের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হবে। কারণ অবৈধ পথে কেবল ভারতেই পাট পাচারের সুযোগ আছে। মাঝখান থেকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ অন্য দেশগুলোর বাজার হারাবে। বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশ থেকে ২০টি দেশে কাঁচাপাট রফতানি হয়ে থাকে। রফতানি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকলে স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে রফতানিকারক বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। তখন পাটের চাহিদা কমলে দামও পড়ে যাবে। উল্লেখ্য, পাট উত্পাদন ও এর প্রক্রিয়াজাতকরণের সঙ্গে দেশের আড়াই কোটি লোক জড়িত। নিজস্ব উদ্যোগে তারা পাট উত্পাদন করেন। রফতানি বন্ধ থাকলে কেবল সরকারি মিলগুলো ন্যায্য দামে উত্পাদিত পাট কিনে নেবে—বস্ত্র ও পাট সচিবের এ ধরনের আশ্বাসে তারা আস্থা রাখতে পারছেন না। কাঁচাপাট রফতানিকারকরা বলছেন, স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি পাটকলগুলোতে বছরে পাটের চাহিদা মাত্র ৩৫ থেকে ৩৮ লাখ বেল। বর্তমান মৌসুমে পাট উত্পাদন হয়েছে প্রায় ৫১ লাখ বেল। এতে যে পাট উদ্বৃত্ত থাকবে সেগুলো পাচার হয়ে যাবে সীমান্তের ওপারে। কাজেই রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে সরকার পক্ষ থেকে স্থানীয় মিলগুলোর জন্য সহজে পাট কেনার যে যুক্তি দেখানো হয়েছে, তা যথাযথ বলে মনে হয় না। কাজেই এরই মধ্যে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএ), রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ পাট সমিতি রফতানি নিষেধাজ্ঞা পাটখাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে বলে যে আশঙ্কা করেছে, তা সরকারকে বিবেচনায় আনতে হবে। পাচার বৃদ্ধি পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সংশয়ের বিষয়টিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিষেধাজ্ঞার ফলে আন্তর্জাতিক বাজার হারানো নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্বেগকেও বাস্তবতার আলোকে বিচার করে দেখতে হবে সরকারকে। মোটকথা, পাটচাষ এবং পাটচাষীদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনোই অবকাশ নেই। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কার স্বার্থে? সব ধরনের নেতিবাচক ও ভ্রান্তনীতি পরিহার করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে এ প্রশ্নের মোক্ষম জবাব। ক্রমশ পিছিয়ে পড়া পাটশিল্পের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে পাট মন্ত্রণালয় তথা সরকার এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবে না—এটাই সংশ্লিষ্ট সবার দাবি।

No comments

Powered by Blogger.