ধর নির্ভয় গান-ভাঙা-গড়ার খেলা by আলী যাকের

হল তৈরি হওয়ার পরে বাকী ইতিহাস তার নতুন ঠিকানা খুঁজে পেল মহিলা সমিতিতে। শুরু হয়ে গেল নাটক মহিলা সমিতি মঞ্চে। আমাদেরই দলের একের পর এক নাটক এলো বিদগ্ধ রমণীকুল ও তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, ক্রস পারপাস, ভেঁপুতে বেহাগ, বহিপীর, শাহজাহান...।


এরপর আমাদের সখ্য নানা দল, যেমন_ থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, বহুবচন, আরণ্যক এবং আরও অনেকেই নাট্যচর্চা শুরু করে দিল এই মহিলা সমিতি মঞ্চে। নিউ বেইলি রোডে অবস্থিত ২২ ফুট ু ২২ ফুট মঞ্চে শুরু হয়ে গেল নাটকের ফল্গুধারা। এখানে অনেক অবিস্মরণীয় নাটক, প্রায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী, কি আঙ্গিক কি প্রতিপাদ্যে, মঞ্চায়িত
হলো সফলভাবে


আজ (বৃহস্পতিবার) যখন এই কলামটি লিখছি, তখন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার দ্বারপ্রান্তে আমরা। এটি অনেকের জন্য তেমন গুরুত্বের নয় হয়তোবা, তবে আমরা যারা সেই সত্তরের দশকের প্রথম থেকেই মঞ্চনাটকের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছি, তাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আমি আমার সত্তায় মঞ্চ, নাটক এবং নাট্যকলা সম্পৃক্ত নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বসবাস করছি গত ৪০ বছর ধরে, সেহেতু এই ঘটনাটিকেই এবারের কলামের প্রতিপাদ্য করতে চাই।
আজ নাটক সরণি, যা একসময় পরিচিত ছিল নিউ বেইলি রোড হিসেবে, সেখানে অবস্থিত মহিলা সমিতি মঞ্চে শেষবারের মতো নাটকাভিনয় হতে যাচ্ছে। এরপর মঞ্চটি ভেঙে ফেলা হবে। এই যে শেষবারের ঘটনা, এর একটি তাৎপর্য আছে। নাটকীয় তাৎপর্য। ইংরেজিতে বলা হয় ঝধিহ ংড়হম. কথিত আছে, রাজহাঁসের চেয়েও বড় যে হাঁস, যা ইংরেজিতে ঝধিহ নামে পরিচিত, এই অতি সুদৃশ্য পাখিটি সারাজীবন নিশ্চুপ থাকে এবং ঠিক যখন তার মৃত্যুর সময় সমাগত হয়, তখন সে সুমধুর কণ্ঠে গেয়ে ওঠে বিদায়ের গান। একজন অভিনেতা সারাটি জীবন নিশ্চুপ না থাকলেও শেষ যে অভিনয়টি করেন তার জীবনে, সেটি আখ্যায়িত হয় ঝধিহ ংড়হম অভিধায়। প্রখ্যাত রুশ নাট্যকার আন্তোন চেকভের লেখা এক বৃদ্ধ অভিনেতার ওপরে একটি নাটক আছে, যার নাম ঝধিহ ংড়হম. আজ মহিলা সমিতির ঝধিহ ংড়হম. মহিলা সমিতি আমাদের বলেছে, এই মঞ্চ ভেঙে ফেলা হলেও এর পরিবর্তে ওই একই জায়গায় আরও তিনটি বিভিন্ন আকারের মঞ্চ তারা তৈরি করবে। অতএব, আশা করা যায় নাটক সরণি আবার নাটুকে আমোদে রমরমা হয়ে উঠবে অচিরেই। ওই মঞ্চগুলো আবার সরব হবে নবীন-প্রবীণ নাট্যজনের পদচারণায়।
১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন শুরু হয় ফুলার রোডে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে। নাটকটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের নাট্যকার প্রয়াত বাদল সরকার রচিত বাকী ইতিহাস। পরপর আট রোববার সকাল ১১টায় এই নাটকের মঞ্চায়ন হয় ব্রিটিশ কাউন্সিলে। ঢাকার নাট্যরসিকজন হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেন একটি নতুন শিল্পকর্মের অবিচ্ছেদ্য যাত্রা শুরু হয়ে গেল আমাদের এই প্রিয় শহরে। বাকী ইতিহাস-এর প্রযোজনায় ছিল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। অভিনয়ে আবুল হায়াত, সারা আমিন (যাকের), নায়লা জামান (খান), আতাউর রহমান প্রমুখ প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতারা। নির্দেশনার দায়িত্ব বর্তেছিল আমার ওপরে। এই ৮টি মঞ্চায়ন শেষে আমাদের ব্রিটিশ কাউন্সিল ছাড়তে হয়। কেননা ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তনে তখন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে জিসিএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র ধার্য করা হয়েছিল। আমাদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। এত উদ্যম, এত প্রত্যাশা, এত স্বপ্ন নিয়ে একটি শিল্পমাধ্যমের যাত্রা শুরু করেছি; মঞ্চের অভাবে তা থেমে যাবে, আমাদের মন তা কিছুতেই মানতে পারছিল না। অতএব, খোঁজ শুরু হলো আর কোথায় মঞ্চ আছে? সেই সময় আমাদের অন্যতম অভিনেত্রী সারা আমিনই খবর দেয় যে বেইলি রোডে মহিলা সমিতির একটি মঞ্চ আছে। এই মঞ্চে তার বড় ভাই, মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ, শহীদ আলাউদ্দিন মোহাম্মদ যাহীনরা প্রমিথিয়ান্স নামে একটি দলের প্রযোজনায় কয়েকটি ইংরেজি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। অতএব হলটি তার চেনা। আমরা তাকে বললাম, হলটিতে গিয়ে সরেজমিন দেখে মঞ্চের মাপ সংগ্রহ করে হলটি আসলেই আমাদের জন্য অভিনয় করবার উপযোগী কি-না সে বিষয়ে আমাদের জানাতে। সারা তার এক বোনকে নিয়ে মঞ্চের মাপ সংগ্রহ করল এবং এসে আমাদের জানাল যে হলটি অত্যন্ত দুরবস্থায় আছে। কিন্তু এটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে কাজে লাগানো যেতে পারে। আমাদের দলের সব নাট্যকর্মী তখন কোমর বেঁধে লেগে গেলাম হলকে নাট্যাভিনয়ের উপযোগী করে তুলতে। সেই সময় মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা না করত তাহলে আমাদের পক্ষে এই কাজটি করা দুঃসাধ্য হতো। প্রসঙ্গত মনে পড়ে,পরম শ্রদ্ধেয়া প্রয়াত নীলিমা ইব্রাহিম এবং আইভি রহমানের কথা। এঁরাই ছিলেন মহিলা সমিতির কাণ্ডারি। এঁরা বাংলাদেশের নাট্যচর্চার জন্য যা করেছেন, তা প্রতিটি নাট্যজনের স্মরণে রাখতেই হবে।
হল তৈরি হওয়ার পরে বাকী ইতিহাস তার নতুন ঠিকানা খুঁজে পেল মহিলা সমিতিতে। শুরু হয়ে গেল নাটক মহিলা সমিতি মঞ্চে। আমাদেরই দলের একের পর এক নাটক এলো বিদগ্ধ রমণীকুল ও তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, ক্রস পারপাস, ভেঁপুতে বেহাগ, বহিপীর, শাহজাহান...। চলতে লাগল নাটকের পর নাটক। এরপর আমাদের সখ্য নানা দল, যেমন_ থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, বহুবচন, আরণ্যক এবং আরও অনেকেই নাট্যচর্চা শুরু করে দিল এই মহিলা সমিতি মঞ্চে। নিউ বেইলি রোডে অবস্থিত ২২ ফুট ু ২২ ফুট মঞ্চে শুরু হয়ে গেল নাটকের ফল্গুধারা। এখানে অনেক অবিস্মরণীয় নাটক, প্রায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী, কি আঙ্গিক কি প্রতিপাদ্যে, মঞ্চায়িত হলো সফলভাবে। সংঘটিত হতে থাকল দেশীয় ও বিদেশি দল সমন্বয়ে নাটোৎসব। এই মঞ্চে অভিনয় করেছে কলকাতার বহুরূপী, নান্দিকার, থিয়েটার ওয়ার্কশপ, অন্য থিয়েটার, চেতনা, রঙ্গকর্মী প্রমুখ অগ্রণী দল।
এখানে একটি অতি ব্যক্তিগত কথা উল্লেখ না করে পারছি না। আমার এবং সারার কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়া যখন মার্কিন স্কলারশিপের জন্য আবেদন করে তখন তাকে একটি মৌলিক রচনা লিখতে হয়েছিল। সেই রচনাটি শুরুই হয়েছিল ওর বাল্যকালের বর্ণনা দিয়ে। আমরা মঞ্চে নাটক করছি, আর চার বছরের শ্রিয়া আমাদের মেক-আপ শিল্পী প্রয়াত বঙ্গজিৎ দত্তকে দিয়ে মেক-আপ করিয়ে নিচ্ছে সারা মুখে। মেক-আপ করা হয়ে গেছে বললেও মানছে না শ্রিয়া। আরও বেশি চড়া রঙের প্রলেপ দিতে বলছে মুখের ওপর। আমরা মঞ্চ থেকে মেক-আপ রুমে এসে ওর চেহারা দেখে হতবাক হয়ে গেছি। হেসে গড়িয়ে পড়ার অবস্থা। ওই রচনাটি প্রভূত সুখ্যাতি অর্জন করেছিল, শ্রিয়া যেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিল। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় আমাদের সহযাত্রী প্রয়াত বঙ্গজিৎদার কথা। মনে পড়ে মেক-আপ শিল্পী সালাম ও তপনের কথা। আলোক প্রক্ষেপক সিরাজের কথা। আর আমাদের একান্ত প্রিয় শক্তিশালী নট, নাট্যকার, নির্দেশক প্রয়াত আবদুল্লাহ্ আল মামুনের কথা, প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনের কথা। এই রকম কত গুণীজনের পদচারণায় মুখর ছিল এই মহিলা সমিতি। নাটক শেষে আমরা মঞ্চায়নের সুখস্মৃতিকে ধরে রাখতে চাইতাম। আর সেই কারণেই যত রাতই হোক মহিলা সমিতির সিঁড়ির ওপরে বসে আড্ডা দিতাম আমরা। হাসিমুখে চায়ের সরবরাহ করত মিলনায়তনের তত্ত্বাবধায়ক তারা মিয়া। আমার মনে আছে, প্রচণ্ড গরমে যখন প্রাণ আঁইঢাঁই, সেই পরম শারীরিক যন্ত্রণাকে তুচ্ছ করে, মঞ্চের ওপরে অজস্র ঘাম ঝরিয়ে, রাতের পর রাত আমরা অভিনয় করে গেছি এই মহিলা সমিতি মঞ্চে। তখন তো একটা স্লোগানই চালু হয়ে গিয়েছিল, 'নাটক আমাদের রক্ত-ঘামের ফসল'। মঞ্চে রক্তপাত কতটা ঘটেছে সে কথা বলতে পারব না। তবে ঘাম যে অপ্রতুল ছিল না, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিদেশি নাট্য বিশেষজ্ঞরা যখন আমাদের সঙ্গে কর্মশালা কিংবা অভিনয় প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করতে আসতেন, অবাক হয়ে যেতেন। তারা ভাবতেই পারতেন না কী করে সারাদিন অন্যত্র পেশার কাজে নিয়োজিত থেকে প্রতি সন্ধ্যায় গলদঘর্ম হয়ে এমন প্রাগৈতিহাসিক সরঞ্জামাদি দিয়ে দিনের পর দিন মঞ্চনাটক চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। খড়হফড়হ অপধফবসু ড়ভ গঁংরপ ধহফ উৎধসধঃরপ অৎঃ-এর সাবেক পরিচালক রজার ক্রাউচার একবার কথাচ্ছলে আমায় বলেছিলেন, 'ওঃ রং যধৎফ ঃড় নবষরবাব ঃযধঃ ুড়ঁ ধষষ ধৎব ধসধঃবঁৎ ঃযবধঃৎব ড়িৎশবৎং. ণড়ঁ ধৎব রহফববফ ঢ়ৎড়ভবংংরড়হধষং.' তখন আমরা সবাই মহাউৎসাহে মঞ্চ এবং মিলনায়তন ঝাড় দেওয়া থেকে শুরু করে মঞ্চ নির্মাণ, অভিনয় এবং সেট সরানোয় নিয়মিতভাবেই দৈহিক পরিশ্রম করে যেতাম।
এই স্বল্প পরিসরে সব কথা বলা সম্ভব নয় মহিলা সমিতিকে ঘিরে। সব মানুষের নাম উল্লেখ করাও দুঃসাধ্য। তবে আজকের অনেক সফল নাট্যজন, যে কোনো মাধ্যমে এবং এমনকি অনেক সফল মানুষ, যে কোনো ক্ষেত্রে, কোনো এক সময় এই মঞ্চে পা রেখেছিলেন এ কথা নিদ্বর্িধায় বলা যায়। আজ মহিলা সমিতির ঝধিহ ংড়হম-এ চোখ ভিজে আসে, চোখ ভেসে যায় আমাদের। মনে হয় অতি প্রিয়জনের শেষকৃত্য সমাগত। তবুও আমি আশা হারাই না। যদি বেঁচে থাকি, ফিরব আবার এই মঞ্চে, যত বয়সই হোক, আবার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে। অভিবাদন আমার সকল সহযাত্রীকে, সেই '৭৩ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন মঞ্চনাটকের এই মন্দিরে। অভিবাদন মহিলা সমিতিকে।

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.