চারদিক-গৈলা স্কুল—গৌরবের ১২০ বছর

খন স্কুলে পড়ি, তখন আমাদের শিক্ষার হার ছিল মাত্র ২৪ ভাগ। কিন্তু আমার কাছে তা যেন বিশ্বাসযোগ্য মনে হতো না। কারণ, আমাদের আশপাশে যাদের দেখতাম, তারা তো সবাই কমবেশি লেখাপড়া জানে! নাম লিখতে পারে।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়ছে।


কতজন বড় চাকরি করছে, কতজন ভারতে চলে গেছে, আমেরিকা-ইউরোপে গেছে বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে। তো অশিক্ষিত কোথায়! সারা দেশ থেকে এই যে ব্যতিক্রম, তার কেন্দ্রে রয়েছে আমাদের স্মৃতিময় গৈলা স্কুল—প্রাতিষ্ঠানিক নাম গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা গ্রামে অবস্থিত এ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল গৈলা হাই ইংলিশ স্কুল। এ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু ১৮৯৩ সালের ২৩ জানুয়ারি। আজ ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি স্কুলটি ১২০তম বছরে পা রাখল—জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে কী অসাধারণ অভিযাত্রা! শুভ হোক ১২০তম জন্মদিন।
ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হিসেবে এবং এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ও এর জায়গা প্রদানে আমাদের পরিবারের বিশেষ অবদানের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে গৌরব বোধ করছি।
গৈলা একটি ইউনিয়নের নাম। এর আওতায় অনেকগুলো গ্রাম রয়েছে, কিন্তু সাধারণভাবে সব গ্রামের পরিচয় গৈলা হিসেবে। স্কুল, ডাকঘর, বাজার, হাসপাতাল—সবকিছুর পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গৈলা। এ গ্রামেই জন্মেছিলেন মনসামঙ্গলের কবি বিজয় গুপ্ত। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দির ৫০০ বছরের পুরোনো। বেহুলা-লখিন্দরের আখ্যান নিয়ে রচিত বৃহৎ এ কাব্য গ্রামের হিন্দু রমণীদের মুখস্থ। গৈলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের কৃতী ছাত্র অমিয় দাশগুপ্ত, যাঁর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় ‘অর্থনীতিবিদদের অর্থনীতিবিদ’ হিসেবে। তিনি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের পিএইচডির গাইড ছিলেন। অমর্ত্য সেন লিখেছেন, ‘মাস্টার মশাই (অমিয় দাশগুপ্ত) সব সময় বলতেন, আমার জীবনে যা কিছু অর্জন তার মূলে গৈলা স্কুল।’ গৈলা স্কুল থেকে যাঁরা দশকের পর দশক ধরে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে চলেছেন, তাঁরা একইভাবে বলতে পারেন গৈলা স্কুলই আমাদের গড়ে তুলেছে। জীবনসংগ্রামে সফল হতে প্রেরণা জুগিয়ে চলেছে।
স্কুলের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কৈলাশ চন্দ্র সেন। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি ছেড়েছেন গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন এ স্কুলে। তাঁর সমাধিসৌধে একটিই বাক্য—ডেথ ডিভাইডস, মেমোরি লিঙ্গারস। কী সত্যই না এতে উচ্চারিত! এখনো তিনি প্রাতঃস্মরণীয় নাম। গৈলা স্কুল পরিচালনার পাশাপাশি তিনি পাশের গ্রাম আগৈলঝাড়ায় গড়ে ওঠা ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমি গড়ে তোলায় অনন্য ভূমিকা রাখেন।
১৯৯৩ সালে গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে সাবেক শিক্ষার্থীরা নিজেদের অর্থে গড়ে তোলেন ‘শতবর্ষ ভবন’।
গৈলা স্কুলে ২০০১ সাল থেকে চালু রয়েছে সৈয়দ আবুল হোসেন ছাত্রবৃত্তি। প্রতিবছর তৃতীয় থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান লাভকারীকে এ তহবিল থেকে বৃত্তি দেওয়া হয়। মাধ্যমিক পরীক্ষায় যারা কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়, তারাও এ তহবিল থেকে বৃত্তি পায়। সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন গৈলা পরিষদের নেতারা এ বৃত্তি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। গৈলা পরিষদের আরেকটি উদ্যোগ প্রতিবছরে পুনর্মিলনীর আয়োজন। প্রতিটি আয়োজনেই শত শত শিক্ষার্থী পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উপস্থিত থাকেন।
ষাটের দশকের শেষ দিকে আমি যখন এ স্কুলে পড়েছি, তখন অঙ্ক পড়াতেন নলিনী সিমলাই। তিনি রাগী ছিলেন, কিন্তু অঙ্কশাস্ত্রের প্রতি তাঁর অনুরাগ তুলনাহীন। তাঁর উপদেশ ছিল, কখনো অন্যকে নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে হবে নিজেকে। আমাদের স্কুলের ক্লাসে একবার তিনি একটি অঙ্ক মেলাতে পারেননি। স্কুল শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরেছি। সন্ধ্যায় দেখতে পাই স্যার আমাদের বাড়িতে চলে এসেছেন। বিনম্র স্যার হেসে বললেন, ‘স্কুল থেকে বাড়ি যেতে যেতে ভাবছিলাম—অঙ্ক মিলবে না কেন, গলদ কোথায়! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সমাধান পেয়ে যাই। ভাবলাম, বাড়ি যাবার আগে তোকে দেখিয়ে দিয়ে যাই।’ সারা জীবন এ স্মৃতি আমাকে আঁকড়ে থাকবে! নলিনী সিমলাই, অশ্রু বিশ্বাস, মোহাম্মদ হানিফ, ফজলুর রহমান (লাল মিয়া), জীবন মুখার্জি—আমার নমস্য সব শিক্ষকই ছিলেন শিক্ষাবিস্তারে এমনই উৎসর্গীকৃত।
এ স্কুলের মাঠেই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণের প্রথম পাঠ। আমাদের প্রশিক্ষকদের একজন ছিলেন আলাউদ্দিন বক্স। তিনি দেড় বছরের শিশুপুত্রকে রেখে চলে যান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে রুখতে—২৫ এপ্রিল টরকি বন্দরের কাছে রণাঙ্গনে শহীদ হন। স্কুলের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের আরেক মহান শহীদ তারক সেনের স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি।
গৈলা স্কুল বরাবরই পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ-বহির্ভূত কার্যক্রমেও এগিয়ে। ফুটবলে আন্তস্কুল ফুটবলে জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ক্রিকেট, ভলিবল, ব্যাডমিন্টনেও কৃতিত্ব অনেক। সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সক্রিয় পদচারণা।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের প্রাণপ্রিয় এ প্রতিষ্ঠানটি বোধহয় অতীত গৌরব ঠিকমতো ধরে রাখতে পারছে না! তবে কি দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ক্লান্ত! আজ সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ও আদর্শ শিক্ষকের বড় প্রয়োজন।
অসীম দাশগুপ্ত

No comments

Powered by Blogger.