একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল-তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল নিয়ে আলোচনায় প্রস্তুত বিএনপি by লোটন একরাম

হুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রক্রিয়া নিয়ে সংসদের ভেতর বা বাইরে যে কোনো স্থানে আলোচনায় প্রস্তুত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। এ আলোচনা সংসদের ভেতর বা বাইরে যে কোনো স্থানেই হতে পারে। তবে সেটা হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের এজেন্ডাতে।


সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে দলীয় সরকারের বাইরে কীভাবে 'নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক' গঠন হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি তারা। একই সঙ্গে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে বিএনপির কাছে ফর্মুলা জানতে চাইলে তারা তা বিবেচনা করবেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের জেলা প্রশাসক নিয়োগ প্রশ্নে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে অনির্বাচিত প্রশাসকদের নিয়োগ বাতিল করবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জেলা পরিষদ গঠন করবে।
গতকাল শনিবার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একান্ত সাক্ষাৎকারে সমকালকে এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল। এ সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারে বিএনপির অবস্থান, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগ, ঢাকা সিটি করপোরেশন বিভক্তি, সংসদে যোগদান, টিপাইমুখে বাঁধ, চারদলীয় জোট সম্প্রসারণ, সরকার-সৃষ্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু, রোডমার্চের পর আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। অবশ্য কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর এড়িয়েও যান। শুধু বলেন, এখনও ওইসব বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলার সময় হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে সংসদে যোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নতুন কোনো ফর্মুলা থাকলে তা পেশ করার আহ্বান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে ফর্মুলা দেওয়ার প্রস্তাব দিলে বিএনপি তা বিবেচনা করবে। আসলে সরকার এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে নিজেদের হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তবে দেশের আপামর জনগণ তাদের সে দূরভিসন্ধি বাস্তবায়ন হতে দেবে না।
আওয়ামী লীগ সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে বিএনপি কী করবে_ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করলে দেশের সাধারণ জনগণ ও বহির্বিশ্বে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তারা আশা করেন, সারাদেশের আপামর জনগণের দাবির সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও একমত পোষণ করবেন। তারা শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে একতরফা নির্বাচনের মতো গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ষড়যন্ত্র থেকে সরে আসবেন।
সরকার বিএনপির দাবি না মানলে কী করবেন জানতে চাইলে দলের মহাসচিব বলেন, তীব্র গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করা হবে। দেশের অধিকাংশ মানুষের দাবি অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই দেশে আগামী নির্বাচন হতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে জনমত গড়তে চলমান রোডমার্চের পর বিএনপি নতুন কী কর্মসূচি দেবে জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, আগামী জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চের মধ্য দিয়ে ওই কর্মসূচি শেষ হবে। রোডমার্চ শেষে চট্টগ্রামের বিশাল জনসমাবেশ থেকে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সংলাপের উদ্যোগে সাড়া দেওয়ার প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ইতিপূর্বে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারি দলের সঙ্গে আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন এবং প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। আমরা এখনও সে অবস্থানেই আছি। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তবে পূর্বশর্ত হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচন করবে না_ এমন শর্তে সংলাপ হতে পারে। তবে দলীয় ফোরামে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জেলা পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের প্রশাসক নিয়োগ সম্পর্কে দলীয় অবস্থান জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, জেলা পরিষদে অনির্বাচিত প্রশাসক নিয়োগ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরিষ্কার বলা আছে, কোনো অবস্থায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা অনির্বাচিতদের দ্বারা পরিচালিত হতে পারবে না। করলে তা বেআইনি হবে। কাজেই আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রশাসক নিয়োগ সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমনকি এর ওপর ভিত্তি করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়েছে। অথচ এখন আবার অনির্বাচিত ব্যক্তিদের প্রশাসক করা হয়েছে।
আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে জেলা পরিষদ বাতিল কিংবা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবে কি-না প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, হ্যাঁ, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে অনির্বাচিত দলীয় প্রশাসকদের নিয়োগ বাতিল করা হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা জেলা পরিষদ গঠন করবেন তারা।
বিএনপি সংসদে না যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল বলেন, তারা সংসদে যেতে চান। কিন্তু সরকারি দল সংসদে যোগ দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করছে না। তারা জাতীয় সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করতে দেন না। সংসদে শুধু বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে গালমন্দই বেশি হয়। অথচ বিরোধী দলের সাংসদরা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ৩ হাজার নোটিশ জমা দিলে স্পিকার তার একটিও গ্রহণ করেননি। এ পরিস্থিতিতে সংসদে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। তবে সরকার পরিবেশ সৃষ্টি করলে তারা সংসদে যাবেন।
ডিসিসি বিভক্তির বিরুদ্ধে বিএনপির পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা আলমগীর বলেন, সব মহলের বিরোধিতা উপেক্ষা করে সরকার ঐতিহ্যবাহী ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করার প্রতিবাদে এরই মধ্যে কিছু কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। ঢাকাবাসীকে নিয়ে চলতি মাসেই তারা বৃহত্তর আন্দোলন কর্মসূচি গ্রহণ করবেন।
টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার প্রতিবাদে বিএনপির নতুন কী কর্মসূচি আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কর্মসূচি নেবেন তারা। সিলেট অভিমুখে লংমার্চ করবেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না।
সরকার বিরোধী দলকে একের পর এক নতুন ইস্যু সৃষ্টি করে দেওয়ার নেপথ্যে কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কি-না জানতে চাইলে ফখরুল বলেন, দেশ পরিচালনায় সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে মহাজোট সরকার। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে তাদের ব্যর্থতা আড়াল করতে চাইছেন।
বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবি তোলায় দলের ভেতরে ও বাইরে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলে খবর হওয়া সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে মির্জা ফখরুল বলেন, বিষয়টির পুরোপুরি ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে বিচার বন্ধ করতে বলা হয়নি। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে নয়। তবে বিচার প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের_ কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়। বর্তমান ট্রাইব্যুনালটি বিতর্কিত হওয়ায় তারা পুনর্গঠনের দাবি করেছেন। এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধের ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্ট বিদেশিরাও এ ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে গেছেন। কাজেই বিচার প্রক্রিয়া যাতে প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সে জন্যই তারা পুনর্গঠনের দাবি তুলেছেন। এ নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।
মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে তিন বছরের মাথায় লাগাতার কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার মতো এখনও যুক্তিসঙ্গত সময় হয়নি বলে অনেকে মনে করেন_ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের ব্যর্থতা ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে বিএনপি আন্দোলনে নামতে বাধ্য হয়েছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সরকার কোনো যুক্তিই মেনে নিতে চায় না। দেশে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বিরোধী দলের আন্দোলন থামাতে গুপ্তহত্যা শুরু করা হয়েছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মাত্র চার-পাঁচ মিনিটে গণবিরোধী আইন পাস করছে। এ পরিস্থিতিতে আন্দোলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
চারদলীয় জোট সম্প্রসারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে চারদলীয় জোটকে শিগগির সম্প্রসারণ করা হবে। এরই মধ্যে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ (এলডিপি) বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল চারদলীয় জোটভুক্ত হওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। অচিরেই চারদলীয় জোট ও দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী_ প্রশ্নের জবাবে দলের মহাসচিব বলেন, এ মুহূর্তে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তারা।

No comments

Powered by Blogger.