যারা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে চায় ভবিষ্যতে তাদেরও বিচার হবে-বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সোচ্চার হতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এই বিচার যারা চান, তাদের যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগিতাকারীদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হতে হবে। কেবল যুদ্ধাপরাধী নয়, তাদের যারা রক্ষা করতে চাইবেন_ ভবিষ্যতে তাদেরও বিচার বাংলার মাটিতে হবে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার-আলবদর যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের দোসররা আর যেন এ দেশের ক্ষমতায় এসে মানুষের ভাগ্য নিয়ে
ছিনিমিনি খেলতে না পারে সে জন্য দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এ জন্য আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। এ দেশে আর কখনও স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের ঠাঁই হবে না। প্রধানমন্ত্রী শনিবার রাজধানীর
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার উদ্দেশে তিনি বলেন, দেশের মানুষ শান্তিতে থাকায় তিনি অশান্তির আগুনে জ্বলছেন। আর হৃদয়ের এই অশান্তির আগুনে দেশকেও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চাইছেন। তারা কেবল যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় নানা ষড়যন্ত্রই নয়, গুপ্তহত্যা চালিয়ে কুম্ভীরাশ্রুও ঝরাচ্ছেন। এটাই বিএনপির চরিত্র।
২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছিলাম। সেই পথে এগিয়েছিও। শত বাধা সত্ত্বেও ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য পূরণেও এগিয়ে যাচ্ছি।
বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের ইতিহাস তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বিজয়ের ৪০ বছরে এবার মানুষের মধ্যে ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গেছে। সারাদেশেই উৎসবমুখর পরিবেশে বিজয় দিবস উদযাপনে মানুষের ঢল নেমেছিল। বিজয়ের এই স্বতঃস্ফূর্ততা ও আনন্দ-উৎসব যেন অব্যাহত থাকে, সে জন্যই আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শুরু করে গেলেও জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এবার আমরা ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও শুরু করেছি। ইনশাল্লাহ দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই হবে।
যশোরের ঝিকরগাছার বিএনপি নেতা নাজমুল হাসানকে 'গুপ্ত হত্যায়' দায়ী হিসেবে ওই দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, নিজ দলের নেতা হত্যার পর তাকে কুম্ভীরাশ্রু ঝরাতে দেখা গেছে। যশোরের সাংবাদিক শামছুর রহমান, সাইফুল আহাদ মুকুলসহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার জড়িত থাকার কথা শোনা যায়। বিএনপির ওই নেতা যতদিন আছেন, ততদিন যশোরে আরও কত যে হত্যা হবে, তার ঠিক নেই। খুন করবে আবার কুম্ভীরাশ্রুও ঝরাবে_ এটাই বিএনপির চরিত্র।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪০ বছরের মধ্যে ২৮ বছরই ক্ষমতায় ছিলেন জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ারা। বাকি মাত্র ১২ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল। এই চলি্লশ বছরেও দেশ কেন এগুতে পারল না তার জবাব যারা ২৮ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তাদেরই দিতে হবে। আর তুলনা করে দেখলে বোঝা যাবে, তারা ২৮ বছরে দেশকে কী দিয়েছেন, আর আওয়ামী লীগ ১২ বছরে কী দিয়েছে?
তিনি বলেন, তারা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লুটপাট-হত্যা-ধর্ষণ, জনগণের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার আর যুদ্ধাপরাধী রাজাকার-আলবদরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া কিছুই দিতে পারেননি। আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা এনেছে। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দিয়েছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি দিয়েছে, মানুষকে শান্তি দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিগত আওয়ামী লীগ ও বর্তমান মহাজোট সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে জনগণ কিছু পায়। আওয়ামী লীগ জনগণকে দিতে আসে, নিতে নয়।
তিনি বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, দেশের অর্থনীতি নাকি চলছে না। ক্ষমতায় থাকতে তিনি কি ভালো চালিয়েছেন? ক্ষমতায় থাকতে তিনি কেন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারলেন না, দেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ বানালেন, ১০ টাকার চাল ৪০ টাকা বানালেন_ এর জবাব তাকেই দিতে হবে। ভবিষ্যতে তিনি ক্ষমতায় এলে চালের কেজি ৯০ থেকে ১০০ টাকা হবে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ ও কারাগার থেকে মুক্ত করে পুনর্বাসিত করেন। তাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন, মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী করেছেন। নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া গোলাম আযমদের দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারায় দেশকে পরিচালিত করেছেন। তিনি কী ধরনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াও একই কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য সবকিছু করেছেন। যিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিলেন, সেই ব্যক্তিই এখন খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় দোসর। যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকার-আলবদররাই তার সবচেয়ে প্রিয়ভাজন।
বিএনপি-জামায়াত জোটের পাঁচ বছরের দুঃশাসনের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমেরিকার কোম্পানির মাধ্যমে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেই তারা দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন আর শোষণ চালিয়েছেন। অত্যাচার-নির্যাতনই তাদের চরিত্র।
সভাপতির বক্তব্যে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, খালেদা জিয়া ও তার সঙ্গের লোকেরা, যারা রক্তভেজা জাতীয় পতাকা রাজাকার-আলবদরদের গাড়ি-বাড়িতে তুলে দিয়ে অবমাননা করেছেন_ তাদের সবারই বিচার করতে হবে। দ্রুত এই বিচার না হলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পাবে না।
উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে শহীদের রক্তের ঋণ আমরা শোধ করবই। আর খালেদা জিয়াকে অপপ্রচারের বদলে এ বিচার মেনেও নিতে হবে। তাকে আইনের শাসনও মেনে নিতে হবে।
বিজয় দিবসের দিন জাতীয় স্মৃতিসৌধে সংঘাতের উল্লেখ করে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কখন স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যান সেটা জানা সত্ত্বেও এবং পুলিশের কাছে দেওয়া নিজের সিডিউল ভেঙে খালেদা জিয়া আগে ফুল দিতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। যাতে সেখানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যেন তিনি ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে পারেন। তবে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর কর্মীরা এখনও মরেনি। তাদের অবশ্যই প্রতিহত করবে তারা।
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ঝিকরগাছার বিএনপি নেতা নাজমুল হাসান হত্যার সঙ্গে তরিকুল ইসলামকে দায়ী করে তাকে গ্রেফতারের দাবি জানান।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, মহিলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রওশন জাহান সাথী এমপি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এমএ আজিজ ও সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম। পরিচালনা করেন দলের প্রচার সম্পাদক নূহ-উল-আলম লেনিন ও উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।

No comments

Powered by Blogger.