বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-কবীর চৌধুরী : 'রাষ্ট্রদ্রোহী'র নৈতিকতার জয় by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

৩ ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল সাড়ে ৮টা। অগ্রজ সহকর্মী আলী হাবিব ভাই প্রথমে কবীর স্যারের প্রয়াণের মর্মন্তুদ খবরটা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, এ তো শুধু একটি জীবনের অবসান নয়, মহাজীবনের অবসান বলাটাই শ্রেয়তর। কয়েক প্রজন্মের প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব কবীর স্যারের পরিচয় নির্দিষ্ট করে দেওয়া ভার। জাতীয় অধ্যাপক, সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, শিক্ষাবিদ, গবেষক, দক্ষ প্রশাসক ইত্যাদি শব্দ তাঁর নামের অগ্রভাগে যোগ করার পরও


আরো কিছু বাকি থেকে যায়। তবে সব কিছুর ঊধর্ে্ব তিনি সর্বাগ্রে একজন পাহাড়সম মানুষ, যাঁর পুরো দেহটাই ছিল যেন হৃৎপিণ্ড। প্রজন্মের কাছে তিনি ছিলেন অন্ধকারে বাতিঘর। আজ জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে সব কিছুর ঊধর্ে্ব তিনি চলে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁকে ভুলে থাকা অসম্ভব। এ শক্তিই বা আছে কার? না, তাঁকে ভুলে থাকা তো নয়ই, বরং আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর উপস্থিতি আমরা টের পাব সাংঘাতিকভাবে। এ জন্যই আমরা তাঁর কাছে থাকব তাঁর জন্যই চিরঋণী হয়ে।
মনে পড়ছে একটি ঘটনা। ওই ঘটনাটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অবশ্যই ঐতিহাসিকও বটে। রাষ্ট্রের দায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যাঁরা কাঁধে তুলে নিয়ে গণ-আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতীকী বিচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছিলেন, তাঁরা জাতির বিবেক। তাঁরা তৎকালীন বিএনপি সরকারের চোখে 'রাষ্ট্রদ্রোহী' বনেছিলেন এবং সেই ২৪ জনের অন্যতম ছিলেন কবীর চৌধুরী। আমাদের জানামতে, বিস্ময়কর ও বিশ্বে বিরল আরো একটি ঘটনার কথাও মনে পড়ছে। বিষয়টি হলো, একজন বিচারাধীন 'রাষ্ট্রদ্রোহী'র প্রয়াণে দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক প্রকাশ। তখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় বিএনপি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক (১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি এই কমিটি গঠিত হয়েছিল দেশের ১০১ জন বরেণ্য নাগরিকের সমন্বয়ে। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানের নাগরিক গোলাম আযমকে আমির হিসেবে ঘোষণার পর এই কমিটি গঠনের তাগিদ ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়েছিল) শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রয়াণের পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করে প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছিলেন_একজন বিচারাধীন রাষ্ট্রদ্রোহীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তাঁরা এ কোন সৌজন্য প্রদর্শন করলেন? কারণ ওই সরকারই তাঁকেসহ দেশের শীর্ষ ২৪ জন বরেণ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় অভিযুক্ত করেছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শহীদ জননী জামিনে মুক্ত থাকলেও একজন 'শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদ্রোহী' হিসেবেই তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান ঘটে। তাঁদের শোক প্রকাশের মাধ্যমে এও প্রমাণিত হয়েছিল, তাঁরা 'রাষ্ট্রদ্রোহী' নন। তৎকালীন সরকার যদি সত্যি সত্যি মনে করত তিনি 'রাষ্ট্রদ্রোহী', তাহলে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করতেন না। এ থেকে এও প্রমাণিত হয়েছিল, নৈতিকতার কখনো পরাজয় ঘটে না। কবীর স্যারের মৃত্যুর পরও খালেদা জিয়া শোক প্রকাশ করেছেন এবং দলের পক্ষ থেকে তাঁর মরদেহে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে এই অপ্রচণ্ড সমাজে আবারও প্রমাণ হলো, প্রচণ্ড মানুষদের কিংবা নৈতিকতাবাদীদের কখনো পরাজয় ঘটে না। তৎকালীন বিএনপি সরকারের দৃষ্টিতে যাঁরা ছিলেন 'রাষ্ট্রদ্রোহী', তাঁদের প্রতি পরবর্তী সময়ে বিরুদ্ধবাদীদের শ্রদ্ধার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, সেটাই হচ্ছে প্রগতিবাদী, প্রখর নৈতিকতাবোধসম্পন্নদের চরম বিজয়। এ বিজয়ের আনন্দ শ্রেষ্ঠ 'রাষ্ট্রদ্রোহী'দের উত্তরসূরিদের কাছে অবশ্যই বড় বিষয়। 'সব সম্ভবের দেশ' রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে এ প্রজন্মের যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে আজ বিভ্রান্ত কিংবা স্ববিরোধিতায় মত্ত, তাদের জন্য এটি একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তও বটে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আরেক সহযোদ্ধা, দেশের খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক, কবি, শিল্পকলা বিশ্লেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর শহীদ জননীর প্রয়াণের পর তাঁকে 'শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদ্রোহী' আখ্যা দিয়েছিলেন। স্যার লিখেছিলেন, 'জাহানারা ইমাম এবং তাঁর সহযোগী যোদ্ধারা বিচার এবং ন্যায়বোধকে একটি ব্যবস্থার মধ্যে গ্রথিত করে একটি আন্দোলনকে দশ দিগন্তব্যাপী ব্যাপ্তি দিয়েছেন। সে হচ্ছে হত্যা, মনুষ্যত্ববিরোধী অপরাধ এবং মনুষ্যত্ববিরোধী অপরাধের বিচার সভ্যবোধেরই প্রকাশ। বিচার যদি কোনো ব্যবস্থায় না হয়, সে ব্যবস্থার প্রতিরোধ করা বৈধ। এই বোধটিই সভ্যতার বোধ এবং এই সভ্যবোধ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাহানারা ইমাম লড়াই করেছেন। এই বোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্যই গণ-আদালতের প্রবর্তন, সে জন্যই রাষ্ট্রশক্তি তাঁকে এবং আমাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তিনি অর্থাৎ জাহানারা ইমাম আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদ্রোহী।' নিশ্চয়ই এ ধরনের রাষ্ট্রদ্রোহী হতে বিবেকের পীড়নবোধ হওয়ার কথা নয়। রাষ্ট্রের তৈরি বৈরী ব্যবস্থায় বরং কোনো কোনো সময় রাষ্ট্রদ্রোহী হওয়াটাই শ্রেয় মনে হয়। কবীর স্যারও সে বিবেচনাবোধই আমৃত্যু লালন করে গেছেন। আমৃত্যু যোদ্ধা, অসামান্য জীবনশিল্পী, মৃত্যুঞ্জয়ী কবীর স্যারের কর্ম ও কৃতীর সীমানা কতটা বিস্তৃত, তিনি বিশ্বসাহিত্যকে কত সহজভাবে আমাদের বোধ ও পাঠগম্য করে গেছেন, তাঁর মৌলিক রচনা ও গবেষণালব্ধ ফসল আমাদের কতটা পথ দেখাবে_এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার স্পর্ধা কিংবা যোগ্যতা কোনোটাই আমার নেই। তবে এর পরও এক কথায় বলা যায়, তিনি রেনেসাঁস মানব হয়ে উঠেছিলেন। এমন একজন রেনেসাঁস মানব তাঁর রাষ্ট্র ও জাতির জন্য কতটা অপরিহার্য_এ নিয়ে আলোচনা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। একাত্তরের ঘাতক দালালদের পাশাপাশি চিরকালের ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের চেতনাকে শাণিত করে যাঁরা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম। আমরা আমাদের প্রয়োজনেই তাঁকে চিরদিন হৃদয়ে ধারণ করতে বাধ্য। তাঁর প্রয়াণ যে বিয়োগান্তক যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে, সে যন্ত্রণা জাতির যন্ত্রণাদগ্ধ চিত্তকে দীর্ঘ করছে। বড় বিস্ময়কর যে সাহিত্য ও কর্মের রজ্জু সমানে সমান টেনে নিয়ে তিনি অগ্রসর হয়েছেন। জীবনের প্রায় শেষক্ষণ পর্যন্ত তিনি ছিলেন তাঁর কর্ম ও সৃষ্টিকাজে যুক্ত। তাঁর সম্পন্ন করে যাওয়া কাজ আমাদের জীবনকেও নিঃসন্দেহে অগ্রসর করবে। তাঁর কাজের ফসল বহন করবে কালযান, তিনিও থাকবেন স্মৃতির অমর প্রদেশে। এত অজস্রভাবে তিনি এত কিছু লিখে গেছেন, এত কিছু উপস্থাপন করে গেছেন, এর পর তাঁকে বিস্ময়কর সৃষ্টিশীল মানুষ না বলার কোনোই অবকাশ নেই। এত বিপুল কর্মপ্রয়াস পৃথিবীর মাপেও অবশ্যই এক বিরল ঘটনা। এক অসম্ভব বৈশ্বিক প্রয়াসকে সময়ের গণনায় সামান্য দিন হলেও কাছ থেকে আমরা দেখেছি, অর্থাৎ এ প্রজন্ম দেখেছে। ইদানীং স্যার প্রায়ই বলতেন, মৃত্যুকে আমি যে পাই না। মৃত্যুকে স্যার পাবেন কী করে, তিনি তো মৃত্যুকে জয় করে নিয়েছিলেন। আর এ জন্যই তাঁর দেহাবসান ঘটলেও তিনি আছেন সর্বত্রই।
অসামান্য মনীষায় জীবনভর যুক্তি আর জ্ঞানের আলো ছড়াতে ছড়াতে তিনি চলে গেলেন খুব নীরবে। ঘুমের মধ্যে স্যার চলে গেলেন না ফেরার দেশে। সত্য, ন্যায় ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার নাগরিক আন্দোলনে স্যারের তারুণ্যদীপ্ত উপস্থিতি, তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের মানুষদের আলোকিত করেছে এবং করবেও। শ্রদ্ধাস্পদ আরেক বাঙালি মনীষা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর প্রয়াণে লিখেছেন, 'আমরা আমাদের শেষ বোধিবৃক্ষও হারালাম।' এর মধ্য দিয়ে প্রজন্মের কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে যায়, একজন ক্ষণজন্মার কাছে আরেকজন ক্ষণজন্মা কত বড়, সব ক্ষেত্রে কত ব্যাপক। স্যার এমন এক সময় চলে গেলেন, যখন চারদিকে হিংস্র হায়েনারা আবার তাদের নখ বের করে সব আঁচড়ে দিতে পাঁয়তারা করছে। এই দানবদের প্রতিহত করার সংগ্রামে স্যারের উপস্থিতি অগ্রভাগে খুব প্রয়োজন ছিল। চিরকাল প্রসন্ন থাকাটাও একজন মানুষের পক্ষে খুব দুরূহ। তাঁকে তো কখনোই অপ্রসন্ন দেখা যায়নি! আর এ জন্যই হয়তো সার্বক্ষণিক কর্মধারার প্রয়োজনীয় প্রাণশক্তিরও কোনো কমতি ছিল না তাঁর মধ্যে। তাঁর মেধা ও পরিশ্রমের সঙ্গে এক অসাধারণ যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছিল তাঁর কর্মক্ষেত্রে, যে যোগসূত্র দিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের স্রোতধারাকেও তিনি বেগবান করেছিলেন। কবীর স্যার শারীরিকভাবে নেই_এ সত্য মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হবেও অনেক দিন; কিন্তু তার পরও আমরা শক্তি সঞ্চয় করে শোক কাটিয়ে উঠব আমাদের জন্য রেখে যাওয়া তাঁর অজস্র সৃষ্টির দিকে আরো বেশি করে ঝুঁকে। আমাদের জন্য কবীর স্যার ডালপালা বিস্তৃত বৃক্ষ রেখে গেছেন, যে বৃক্ষের ছায়াতলে আমরা পুষ্ট হব, চেতনা ও মূল্যবোধকে আরো শাণিত করব। আমরা, এই প্রজন্ম যেন সে চেতনা ভুলে না যাই, আমরা যেন সে সন্ধান থেকে পিছিয়ে না আসি। শেষে বলতে হচ্ছে, ইতিহাস সাক্ষ্য_জোয়ান অব আর্করা চিরঞ্জীব। মানুষের মুক্তির মূল্যবোধ কখনো নিশ্চিহ্ন হয় না। আমাদের কাছে কবীর স্যার তো রক্তস্নাত বাংলাদেশ নামের বিশ্বাস আর মূল্যবোধেরও একজন পবিত্র প্রতীক। আমরা সাহস নিতে চাই 'পবিত্র প্রতীকের মৃত্যু নেই'_এই সত্য দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করে। শোক থেকেই প্রতিরোধ ও দ্রোহের অগ্রগমন এবং সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্যার বলতেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। সে তো হতেই হবে; নইলে আমরা বাঁচব কী করে, কী করে বাঁচাব আমাদের স্বপ্নগুলোকে দুঃস্বপ্নের হাত থেকে? হাঁটু গেড়ে স্যারকে প্রণাম।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.